top of page

জীবনবৃত্তান্ত

আবু তাহের

১৯৪৭ সালের শেষ দিকে মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন সিলেটের জুড়ী স্টেশনের স্টেশনমাস্টার। দেশ বিভাগের পর সারা দেশে তখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চলছে। এদেশের হিন্দুরা দলে দলে আসাম চলে যাচ্ছে। এমন সময়েরই এক ঘটনা। শাকাত বক্স নামের কুখ্যাত এক ডাকাত জুড়ী স্টেশনের কাছাকাছি এলাকায় এক হিন্দু সাধুর সবকিছু ছিনতাই করে নিয়ে যাচ্ছিল। ভর দুপুরের অনেকগুলো মানুষ নির্বাকভাবে সে ঘটনাটি দেখছিল। কিন্তু কারোর সাহস হচ্ছিল না শাফাত বক্স ডাকাতকে কিছু বলার। তখন মহিউদ্দিন আহমেদের দশ বছরের ছেলে দু হাত মেলে ডাকাতটির পথ আগলে দাঁড়ায়। তারপর চারপাশের লোকজন এসে কুখ্যাত ডাকাতটিকে ধরে ফেলে।

উপরে বর্ণিত ঘটনার দশ বছরের ছেলেটি, যিনি শাফাত ডাকাতের পথ আগলে দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁর নাম আবু তাহের। ভবিষ্যতের কিংবদন্তি কর্নেল তাহের। বহু বছর পর যিনি ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন আর মৃত্যুর মিনিটখানেক আগে নিজ হাতেই গলায় পরে নিয়েছিলেন ফাঁসির মোটা দড়ি৷ তাঁর সাহস দেখে জেলার, ডাক্তার, জল্লাদ সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল।
বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ আর মা আশরাফুন্নেছা। বাবার স্টেশন মাস্টারের চাকরির সুবাদে আবু তাহেরের জন্ম আসামের বদরপুরে ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর। পৈতৃক নিবাস বর্তমান নেত্রকোণা জেলার পূর্বধলার কাজলা গ্রামে। কিন্তু গ্রামে কোনো দিন স্থায়ীভাবে থাকা হয়ে উঠেনি তাঁদের। বাবার বারবার বদলি তাহের ও তাঁর ভাই-বোনদের বিচিত্র অভিজ্ঞতার শৈশব উপহার দিয়েছে। কখনো আসামের গহিন জঙ্গলে আমলকী বন খুঁজতে যাওয়া আবার কখনো ভাই বোনদের সঙ্গে দল বেঁধে শহরের অলিগলি ঘুরে বেড়িয়ে শৈশবকে সমৃদ্ধ করেছেন তিনি।

১৯৫২ সাল। আবু তাহেরের বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ তখন চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর স্টেশনে চাকরি করেন। তাহেরর শিশুসুলভ সাহসিকতার সাথে তখন সবে রাজনৈতিক মাত্রা যোগ হচ্ছে। তখনকার একটা ঘটনা-রক্তাক্ত ভাষা আন্দোলন সবে শেষ হয়েছে। একদিন তাহের খবর পেলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ষোলশহর স্টেশন পেরিয়ে দোহাজারী যাবেন। ঐদিন তাহের তাঁর কিছু বন্ধু নিয়ে একটি ঝোপের আড়াল থেকে ট্রেনে পাথর ছুঁড়ে মারেন। এই ঘটনা নিয়ে অবশ্য পরে মহিউদ্দিন আহমেদকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল। তাঁকে হুমকি দেয়া হয়েছিল পুর্নবার এরকম ঘটনা ঘটলে তাঁর চাকরি চলে যাবে।

এভাবেই রাজনৈতিক চেতনাগুলো পাকাপোক্তভাবে আসন করে নিচ্ছিল ভবিষ্যৎ কর্নেলের মস্তিষ্কে। যা একদিন তাঁকে মানুষের মুক্তির পথ খোঁজার জন্য বিপ্লবী করে তুলেছিল। ‘প্রবর্তক’ স্কুলে পড়ার সময় তাহেরের এক শিক্ষক ছিলেন যিনি মাস্টারদা সূর্যসেনের সহযোগী। ঐ প্রবীণ শিক্ষকের কাছ থেকে কিশোর তাহের শুনতেন কীভাবে তাঁরা চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুট করেছিলেন, কীভাবে তাঁরা ব্রিটিশবিরোধী নানা আন্দোলন করতেন। প্রবীণ শিক্ষক সেইসব জায়গায় তাহেরকে নিয়ে যেতেন। আর তাঁকে প্রেরণা দেয়ার জন্যই হয়তো বলতেন, ‘আমাদের বয়স ছিল তখন ঠিক তোমার মতো’। ১৫-১৬ বছরের বালক তাহের বিপ্লবের কথা শুনে শিহরিত হতেন। কিন্তু খুব বেশি দিন তিনি সেই শিক্ষকের সঙ্গে থাকতে পারলেন না। কারণ আবার বাবার বদলি। এবার গেলেন কুমিল্লায়। তাহের ভর্তি হন কুমিল্লার ‘ইউসুফ’ স্কুলে। বিতর্ক, আবৃত্তি আর খেলাধুলা করে স্কুলে নিজের পরিচিতি বাড়াতে খুব বেশি সময় লাগেনি তাঁর। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে তাঁর যে টুকটাক যোগাযোগ অথবা এর প্রতি যে আগ্রহ ছিল তা অটুট ছিল কুমিল্লায় এসেও। বরং কুমিল্লায় এসে তা আরো নতুন মাত্রা পায়। ‘কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া’ কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ নেতা তাহের উদ্দিন ঠাকুরের সাথে তাঁর পরিচয় হয়। সেইসাথে কুমিল্লাতে এসে তাঁর পরিচয় হয় প্রচুর বইয়ের সঙ্গে। যা তাঁর সামনে উন্মোচন করে দেয় নতুন এক জগতের। তাহের পরিণত হতে থাকে মূলত তখন থেকেই।

মাধ্যমিক পাশ করার পর তাহের উদ্দিন ঠাকুরের আমন্ত্রণে কুমিল্লার ‘ভিক্টোরিয়া’ কলেজে ভর্তি হবার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু আপত্তি করলেন বড় ভাই আরিফ। তাঁর ধারণা ছিল ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হলে ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়াশোনার প্রতি অমনোযোগী হয়ে যাবেন তিনি। তাই বড় ভাইয়ের ইচ্ছায় তাঁকে ভর্তি হতে হয় সিলেটের এম. সি. কলেজে। দিন রাত শুধু বই পড়তেন। পাঠ্য বই যতটা না পড়তেন তার চেয়ে বেশি পড়তেন বাইরের বই। বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের বিপ্লবের ইতিহাস বেশি পড়তেন তিনি। তখন থেকেই তাঁর মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জাগ্রত হতে থাকে। রুশ বিপ্লব, চীন বিপ্লব, এমনকি সাঁওতাল বিদ্রোহ, নানকর আন্দোলন এসব ইতিহাস পড়ে বিপ্লবের জন্য পরিকল্পনা করতেন। কিন্তু বিপ্লবের পথ খুঁজে পেতেন না। তাই পরিকল্পনা করলেন লেখাপড়া শেষ করে সেনাবাহিনীতে যাবেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করে পাকিস্তানিদের এ দেশ থেকে বিতাড়িত করবেন।
এম. সি. কলেজ থেকেই বি.এ. পাস করেন। সেনাবাহিনীতে ভর্তি হবার সুযোগের অপেক্ষায় থাকাকালীন কিছুদিন চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের দুর্গাপুর স্কুলে শিক্ষকতা করেন। লক্ষ্য স্থির ছিল সেনাবাহিনীতে যোগ দেবেন। কিছুদিন পর সে সুযোগ আসে। কিন্তু মৌখিক পরীক্ষায় সুরা মুখস্থ বলতে না পারায় সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়। কিছুটা হতাশ হলেও আশাহত হন না তিনি। অপেক্ষায় থাকেন পরবর্তী সুযোগের জন্য। আর এই অবসরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এম.এ. ভর্তি হন। কিন্তু এম.এ. পড়া শেষ করার পূর্বেই পুনর্বার সুযোগ পেয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি। পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিপ্লব সংগঠিত করার চিন্তা নিয়ে সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষণ শেষে ১৯৬১ সালে বালুচ রেজিমেন্টে কমিশন পান। প্রশিক্ষণকালীন তাঁর নিষ্ঠা অফিসারদের নজরে পড়ে। তাঁকে প্যারাকমান্ডো দলে সুযোগ দেওয়া হয়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে কাশ্মীর আর শিয়ালকোট সেক্টরে যুদ্ধ করেন তিনি। সে যুদ্ধে তিনি আহতও হন। একমাত্র বাঙালি অফিসার হিসাবে তাঁকে ‘মেরুন প্যারাস্যুট উইং’ নামক সম্মাননা প্রদান করা হয়।
১৯৬৯ সালের ৭ আগস্ট পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে ছুটি নিয়ে এসে তাহের বিয়ে করেন লুৎফাকে। কিন্তু শুরুর দিকে একসাথে থাকা হয়নি তাঁদের। স্ত্রী লুৎফা তখন লেখাপড়া করছিলেন। আর তাহেরকে কর্তব্য পালনের জন্য চট্টগ্রাম ব্যারাকে চলে যেতে হয়। বিয়ের কিছুদিন পর প্রথম বাঙালি আর্মি হিসেবে তিনি আমেরিকায় ট্রেনিং এর জন্য যান। কথা ছিল পরীক্ষা শেষ করে লুৎফাও যাবেন আমেরিকায়। কিন্তু ট্রেনিংয়ের নিয়মের কড়াকড়ির জন্য যাওয়া হয়নি লুৎফার। ট্রেনিং শেষে তাহের আর লুৎফা ইংল্যান্ডে বেড়াতে যান তাহেরের ছোট বোন শেলী আর লুৎফার বড় ভাই রাফি আহমেদের আতিথ্যে। তাহের ও লুৎফা দম্পতির এক মেয়ে ও দুই ছেলে। মেয়ে জয়া আর দুই ছেলে যীশু আর মিশু। লুৎফা তাহের পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের উচ্চপদে চাকুরি করে অবসর নিয়েছেন। মেয়ে জয়া, যার জন্ম ১৯৭১ সালে। বড় ছেলে আবু কায়সার যীশুর জন্ম ১৯৭৫ সালে। ছোট ছেলে আবু আহসান মিশু লন্ডনের ব্রাইটনে ‘সাক্সেস’ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। আর তাহেরের ভাই-বোনরা প্রায় সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত।
১৯৭১ সালে পূর্ববঙ্গের মানুষ যখন মুক্তির জন্য অস্থির হয়ে উঠেছিল কর্নেল তাহের তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। চাকুরির কারণে সেইসময় ইসলামাবাদে বসবাস করছিলেন তিনি। ইসলামাবাদে তাহেরের বড় ভাই আরিফুর রহমানও থাকতেন। আর পাশের কোয়ার্টারে থাকতেন ক্যাপ্টেন পারভেজ মোশাররফ (পরবর্তীতে যিনি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন)। দুই পরিবারের মধ্যে একটা সখ্য গড়ে উঠেছিল। তখন এভাবে দিন যাচ্ছিল তাহেরের। তবে তাঁর রাজনীতি চর্চার অভিজ্ঞতার কারণে অনেকটা আগাম বুঝে ফেলেছিলেন যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। বিপদ ঘনিয়ে যেতে পারে ভেবে ১৯৭১ সালের শুরুর দিকেই স্ত্রী লুৎফাকে দেশে পাঠিয়ে দেন।
তাঁর অনুমান মিথ্যে প্রমাণিত হয়নি। ২৫ মার্চ ১৯৭১ ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম ধ্বংসযজ্ঞ চালায় পাকবাহিনী। ২৬ মার্চ ভোরেই সারা দেশেই জানাজানি হয়ে যায় এই নিষ্ঠুরতার কথা। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জেও খবর পৌঁছে গিয়েছিল। লুৎফা তাহের ইসলামাবাদ থেকে ফিরে রাজধানীর ভয়াবহতার কথা ভেবে ঈশ্বরগঞ্জে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন সন্তানসম্ভবা। ইসলামাবাদে তাহের তাঁকে বলেছিলেন তাঁদের একটা মেয়ে হবে। নাম হবে জয়া। তাহেরের কথা যেন সৃষ্টিকর্তার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল যুদ্ধের দামামার মধ্যে জন্ম নেয় জয়া। কিছুদিন পর লুৎফা তাহেরের কাছে ঈশ্বরঞ্জকেও নিরাপদ মনে হয়নি। কারণ, শোনা যাচ্ছিল পাক সেনারা ময়মনসিংহ অবধি এসে পড়েছে। শেষে লুৎফা তাহের শিশু জয়াকে নিয়ে স্বামীর পৈতৃক ভিটা শ্যামগঞ্জের কাজলায় আশ্রয় নেন।
যে দেশকে শোষণ মুক্ত করার প্রত্যয় নিয়ে একদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন সে স্বপ্ন পূরণের দারুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু তিনি নিজে আটকে আছেন শত্রুর আনুগত্যে। বিষয়টা ভাবতেই তাঁর অসহ্য লাগছিল। বাংলাদেশি অন্যান্য অফিসারদেরকে সঙ্গে নিয়ে পালানোর পরিকল্পনা করলেন তিনি। কিন্তু তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ অফিসার তাঁকে নিরুৎসাহিত করলেন এবং তাঁরা অজুহাত দেখালেন যে তাহের যদি একাও পালায় তবে তাঁর জন্য সেখানকার সব বাঙালি অফিসাররা বিপদে পড়তে পারেন। এই যুক্তি দেখিয়ে তাঁরা তাহেরকে অনেকদিন বিরত রাখেন। কিন্তু তাহের ভাবছিলেন পিছনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। যেদিনগুলোতে বিপ্লবের চিন্তা মাথায় ঘুরত সব সময়। এখন সে বিপ্লব থেকে তাঁকে দূরে থাকতে হচ্ছে। বিষয়টা তাঁকে চরম হতাশায় ফেলে দিয়েছিল। আরো হতাশা যুক্ত হলো যখন তাহেরের পালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা উপর মহলে ফাঁস হয়ে গেল। মেজর জেনারেল বি. এম মোস্তফা তাহেরকে ডেকে পাঠিয়ে বলল-‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও সরকার নিয়ে তুমি খারাপ মন্তব্য করেছো’। এই অজুহাতে তাহেরকে নজরবন্দি করা হলো। কিন্তু তাহেরের ভেতর সার্বক্ষণিক চিন্তা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতেই হবে। শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন দেলোয়ার আর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে সঙ্গে পান তাহের। তাঁদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালানোর পথ খুঁজতে শুরু করলেন তিনি। তাঁরা তিনজন জানতেন পালানোর সময় ধরা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যুদ-। তবু স্বদেশের টানে তাঁরা অটুট।
২৯ এপ্রিল পালানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেন। ২৫ জুলাই তাহের, দেলোয়ার আর পাটোয়ারী পাকিস্তানি সেনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে স্বদেশের উদ্দেশে রওনা দেন। নানা ধরনের ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে, সংশয়-সন্দেহকে দূরে ঠেলে অবশেষে তাহের তাঁর দল নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে পৌঁছান।
দেশে পৌঁছেই তিনি প্রথমে দেখা করেন মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীর সঙ্গে। ওসমানী কর্নেল তাহেরকে সমগ্র বাংলাদেশের যুদ্ধাবস্থা নিরিখ করে তাঁকে রিপোর্ট করার দায়িত্ব দেন। সেমতো কাজে নেমে যান তাহের। তিনি গবেষণা চালিয়ে দেখেন যে, বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চল নিয়ে গঠিত হওয়া ১১ নম্বর সেক্টরটি যুদ্ধের জন্য অত্যন্ত সম্ভাবনার। ঠিক তখনই ‘জেড ফোর্স’ গঠিত হলে জিয়াউর রহমান ‘জেড ফোর্সের’ দায়িত্ব নিলে কর্নেল তাহের এগারো নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব চান। জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীও রাজি হন তাহেরের কথায়। শুরু হয় কর্নেল তাহেরের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কাক্সিক্ষত অধ্যায়। জুলাই মাসে তিনি ১১ নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করতে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে তিনি যুদ্ধটি শেষ করতে পারলেন না। কামালপুর অপারেশনের মাধ্যমে যুদ্ধের সবচেয়ে সম্ভাবনার দুয়ারটি খুলতে গিয়ে ঐ অপারেশনে তিনি মর্টার সেলের আঘাতে তাঁর একটি পা উড়ে যায়। আহত তাহেরকে চিকিৎসার জন্য ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। সুস্থ হয়ে কৃত্রিম পায়ে ভর দিয়ে তাহের দেশে ফিরে আসেন ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাসে। জেনারেল এম.এ.জি ওসমানী তখনো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান। যুদ্ধাহত তাহেরকে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে ‘অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল’ পদ দেন। তাহের তাঁর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরই তাঁকে কুমিল্লায় ৪৪নং ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে বদলি করা হয়।
১৯৭২ সালের শেষের দিকে কর্নেল তাহের একটি উৎপাদনমুখী সেনাবাহিনী গঠনের রূপরেখা রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেন৷ কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাহেরের স্বপ্নের সে রূপরেখা গ্রহণ না করায় অভিমানে তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেয়ার পর দুই বছর কর্নেল তাহেরকে বাধ্য হয়ে অনেকটা বাঁধা-ধরা জীবন যাপন করতে হয়৷ বাল্যকাল থেকেই যিনি শোষণমুক্ত সমাজের কথা ভাবতেন, নেতৃত্ব ছিল যাঁর সহজাত গুণ, সে মানুষটিকে একেবারে নিষ্ক্রিয় জীবন-যাপন করতে হয়। সামরিক বাহিনী থেকে অবসর নেয়ার দুই বছরের মধ্যে রাজনীতিতে যোগদান বা দল গঠন না করার আইনি বাধা ছিল। তাই ঐ দুই বছর তিনি ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক চাকরি করেন।
১৯৭৪ সালে আইনি বাধা দূর হলে কর্নেল তাহের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)-এর হয়ে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন। তাহেরের দীর্ঘ জীবন সামরিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে অতিবাহিত হলেও রাজনীতির চর্চা তাঁর ছাত্র জীবন থেকেই ছিল। শখের রাজনীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের রাজনীতি নয়। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন প্রতিবাদী আর বিপ্লবী মানুষ। ‘কমিউনিস্ট মেনিফিস্টো’ তাঁর ছাত্র জীবনেই পড়া ছিল। সেই জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে তিনি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেন এবং তিনি বিপ্লবের স্বার্থে বামপন্থী মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নিহত হন সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল ও বিপথগামী অফিসারের ষড়যন্ত্রে ও প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে খালেদ মোশাররফ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখল করেই জিয়াউর রহমানকে বন্দী করেন। কর্নেল তাহের রাজনীতির চর্চা করতেন বলেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে চাইতেন না রাষ্ট্র সামরিক যাঁতাকলে পিষ্ট হোক। কারণ ইতিহাস বলে সামরিক শাসন রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে না। তাই তিনি এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। ‘জাসদ’ এর নেতৃত্বে ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বর এক ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার বিপ্লব সংগঠিত হয়। মেজর জিয়াকে মুক্ত করে আনেন তাহের।
কর্নেল তাহের চেয়েছিলেন সমাজতান্ত্রিক সরকার। সেখানে সমাজের মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু তাঁর বিপ্লব হিতে বিপরীত হয়ে যায়। পাল্টা অভ্যুত্থানের পর মেজর জিয়াউর রহমান সেনাবাহিনীর ‘চিফ অফ স্টাফ’ নিযুক্ত হয়ে রাষ্ট্রকে পুনরায় সামরিক জান্তার কবলে পতিত করেন। জিয়উর রহমান কর্নেল তাহেরকে সামরিক সরকারে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান। কিন্তু তাহের জিয়াউর রহমানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
সামরিক সরকার তার চরিত্র অনুযায়ী কর্নেল তাহেরসহ জাসদের ৩৩ জন নেতাকে বন্দী করে। তারপর তাঁর সমগ্র পরিবার রাষ্ট্রীয় ক্রোধের মধ্যে পড়ে। ১৯৭৬ সালের জুন মাসে কেন্দ্রীয় কারাগারে তারকাঁটা দিয়ে স্থান নির্দিষ্ট করে কর্নেল তাহেরসহ ৩৩ জন বন্দীর অবৈধ বিচার শুরু হয়৷
১৭ জুলাই বিশেষ সামরিক আদালত জিয়ার ইচ্ছায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসির আদেশ দেয়। ২১ জুলাই ভোরবেলা কর্নেল তাহের কবিতা আবৃত্তি করতে করতে ফাঁসির মঞ্চে যান। সমাপ্তি ঘটে এক বিপ্লবী জীবনের।
লেখক : কামরান পারভেজ

তথ্যসূত্র: gunijan.org.bd

bottom of page