ভূমিকা
২০০৫ সালের ২৯ আগস্ট মহামান্য হাইকোর্ট বাংলাদেশের অন্যতম কালো আইন বলে পরিচিত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন। এর প্রায় পাঁচ বছর পর ২০১০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম সংশোধনী বাতিল আদেশের বিরুদ্ধে দায়ের করা আপিল আবেদনটিও খারিজ করেন মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। তখন অনেকটা হঠাৎ করেই তাহেরের অনুসারীদের সামনে হাইকোর্টের দুয়ার খুলে যায় তাহের হত্যার বিচার চাওয়ার জন্য। জেনারেল জিয়াউর রহমান পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত তখনকার মার্শাল ল অথরিটি দ্বারা জারিকৃত সকল ফরমান, আদেশ, নির্দেশ, বিধি ইত্যাদিকে বৈধতা প্রদান করেন। একই সঙ্গে সেই সংশোধনীতে এও বলা হয় যে, কোনো কোর্ট, ট্রাইব্যুনাল বা অথরিটির কাছে ওগুলোর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। তাই এই পঞ্চম সংশোধনীই ছিল আদালতের কাছে বিচার চাওয়ার ক্ষেত্রে একমাত্র প্রতিবন্ধকতা। ২০১০ সালের ২৩ আগস্ট একটি ঐতিহাসিক দিন। এ দিন তাহেরের ভাই আনোয়ার হোসেন, স্ত্রী লুৎফা তাহের এবং সামরিক আদালতের বিচারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত অপর ভাই ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফের দায়ের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এক আদেশে কর্নেল তাহের বীরউত্তমের ফাঁসি ও গোপন বিচারসংক্রান্ত সব নথি হাইকোর্টে তলব করেন। একই সঙ্গে তাহেরের ফাঁসির আদেশ কেন অসাংবিধানিক ও অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানাতে সরকারকে নির্দেশ দেন। দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১১ সালের ২২ মার্চ রায় দেন আদালত। হাইকোর্ট কর্নেল তাহেরের বিচারকে অবৈধ ঘোষণা করেন। আদালত বলেন, ১৯৭৬ সালের স্পেশাল মার্শাল ’ল ট্রাইব্যুনাল বা বিশেষ সামরিক আদালতের বিচার ছিল লোক দেখানো প্রহসন এবং কর্নেল তাহেরের ফাঁসি ছিল ঠান্ডা মাথায় একটি পরিকল্পিত হত্যা। রায়ে এও বলা হয় যে, কর্নেল তাহেরের হত্যাকান্ডের প্রধান পরিকল্পনাকারী ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় ২০১৩ সালের ২০ মে। তাহের ছিলেন একজন ‘বিপ্লবী’। তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন একটি বিপ্লবী রাষ্ট্রের। বাংলাদেশ অবশ্য এখনো সেই শোষণহীন বিপ্লবী রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারেনি। কিন্তু অবিপ্লবী হয়েও আমাদের অবিপ্লবী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম অবিপ্লবী স্তম্ভ ‘হাইকোর্ট’ ৩৪ বছর পরে হলেও একজন খাঁটি বিপ্লবীর প্রতি করা চরম অবিচারের কথা স্বীকার করেছেন। এখানেই প্রকাশ পায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ‘মহানুভবতা’। যেই দেশ এমন মহানুভবতা দেখাতে কার্পণ্য করে না, সেই দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হওয়া ছাড়া আর কি-ই বা হতে পারে? এই আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাহেরের পরিবার যত না পেয়েছে, তার থেকে অনেক বেশি পেয়েছে অবিপ্লবী বাংলাদেশ রাষ্ট্র। কথাটি অদ্ভূত শোনালেও ২০১১ সালের ২২ মার্চ এমন একটি দিন যেদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার চরম মহানুভবতা প্রকাশের মাধ্যমে নিজের গায়ে লেপটে থাকা বহু বছরের পুরনো একটি কালো দাগ মুছে ফেলে। শেক্সপিয়ার হয়তো এমন ব্যাপারগুলোকেই ‘আইরনি’ বলতেন।