top of page

গোপন বিচার ও তাহের হত্যাকান্ড

ঢাকা কারাগারে গোপন বিচার ও তাহের হত্যাকান্ড

ড. মো. আনোয়ার হোসেন

ঢাকা কারাগারে আমাকে প্রথম পাঠানো হয় ১৫ জুন ১৯৭৬ তারিখ রাতে। এর ৩ মাস পূর্বে ১৫ মার্চ তারিখে সোনবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগ ডিএফআই আমাকে গ্রেপ্তার করে। আমাকে অন্তরীণ রাখা হয়েছিল ক্যান্টনমেন্টের ডিএফআই সেইফ হোল বা নিরাপদ গর্ত নামে পরিচিত একটি অপরিসর সেলে। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে জানা গেলো আমাকে অন্যত্র পাঠানো হবে। ১৫ জুন, যাত্রার দিন একজন সৈনিক চুপিচুপি আমাকে জানালেনÑ‘স্যার সাহস হারাবেন না। আপনাদের সামনে বড় বিপদ’। সে বিপদ যে কতো ভয়াবহ তা বুঝে ছিলাম আরো পরে, ২১ জুলাই ১৯৭৬-এ। যে রাতে তাহেরকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিল ঢাকা কারাগারে অনুষ্ঠিত গোপন বিচারের মহড়া করে।
আসলে ডিএফআই-এ আমার অবস্থানের ঐ সময়টায়ই জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ডিএফআই এবং আরো কয়টি রাষ্ট্রীয় সংস্থা গোপন মামলা সাজানো ও কর্নেল আবু তাহেরকে মেরে ফেলার চক্রান্ত চূড়ান্ত করে। এ সম্পর্কে মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফৎশুলজ তাহের-এর ওপর তাঁর লেখা ‘দ্য আনফিনিশড রেভ্যুল্যুশন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, ১৯৭৬ সালের ঐ সময়ে পাকিস্তান ফেরত সেনা অফিসার এবং বেসামরিক আমলারা তাহেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করতে থাকেন। ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স (এনএসআই)-এর প্রধান এ এস সফদার ছিলেন এদের মধ্যে অন্যতম। তিনি আয়ুব আমলের জ্যেষ্ঠ্যতম বাঙালি গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা। মুজিব হত্যাকা-ের পরপরই তাকে ঐ গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়। অন্যদিকে সে সময়ে ডিএফআইÑএর প্রধান ছিলেন এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলাম। আমার মনে পড়ে ডিএফআই-এর সেইফ হোল-এ একদিন আমাকে দেখতে এসেছিলেন এই আমিনুল ইসলাম। লোহার গ্রিলের বাইরের কাঠের দরজা খুলে আমাকে দেখানো হয়। শিকারি লোহার খাঁচায় অন্তরীণ পশুকে যেমনভাবে দেখেন, তেমনি দূর থেকে আমাকে দেখে চলে যান তিনি।
পূর্বপরিকল্পিত তাহের হত্যা সম্পর্কে জেনারেল জিয়ার অন্যতম সহচর এবং বর্তমান বিএনপি নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তাঁর ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড দ্য চ্যালেঞ্জ অফ ডেভেলপমেন্ট: এ স্টাডি অব পলিটিক্স অ্যান্ড মিলিটারি ইন্টারভেনশনস ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেনÑ“যে তাহের বন্দী জিয়াকে মুক্ত করেছিলেন তাঁকেই ফাঁসিতে ঝোলাতে উদ্যত কেন হলেন জিয়া?…মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি এমন সব অফিসাররা মুজিব হত্যাকা- এবং তারপর মুশতাককে অপসারণের পর জিয়াকে নতুন মিত্র হিসাবে পেয়ে যায়। শ্রেণী হিসাবে তাদেরকে এবং দেশে অবস্থিত সামরিক-বেসামরিক শক্তি কাঠামোটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য একের প্রয়োজন ছিল অপরকে। তাহেরের শাস্তির প্রসঙ্গ যখন উঠলো তখই ঐ পাকিস্তান ফেরত অফিসাররা হত্যাই চাইলেনÑজিয়ার আহুত সভায় ৪৬ জন এমন ঊর্ধ্বতন অফিসারের প্রত্যেকেই শাস্তির সেই চূড়ান্ত রূপটির ব্যাপারেই রায় দিলেন।”
ডিএফআইÑএ আমার ৩ মাস বন্দিত্ব হিসেবের খাতায় নেই। কারণ ১৫ জুন কোর্ট হাজতে নেয়া এবং কারাগারে প্রেরণের দিন থেকে সরকারিভাবে আমার গ্রেফতারের দিন দেখানো হয়।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমার প্রথম রাত কাটে ৪নং খাতায়। এটি সাধারণ কয়েদিদের একটি ওয়ার্ড। ইতিমধ্যে আমার আগমনের খবর ছড়িয়ে পড়েছে। তখন বেশ রাত। ওয়ার্ডের বন্দীদের অনেকে দেখতে এলেন। তাদের কাছেই জানলাম, শীর্ষ জাসদ নেতাদের এ কারাগারে নিয়ে আসা হয়েছে। কর্নেল তাহেরও আছেন এখানেই। একটি গোপন বিচার প্রক্রিয়ার প্রস্তুতিও চলছে বলে জানানো হলো আমাকে। ঐ দিন ১৫ জুনের কাগজে সামরিক অধ্যাদেশ ‘বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইব্যুনাল বিধি ১৯৭৬” জারির সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক বিচারপতি সায়েম এই অধ্যাদেশ জারি করলেও তা যে জেনারেল জিয়ার নির্দেশেই হয়েছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরদিন আমাকে পাঠানো হয় পুরনো ২০ সেল এলাকায়। এরপর থেকে দু-এক দিন পর পর আমাদের এক সেল থেকে অন্য সেলে নিয়ে রাখা হতো। এর মধ্যে ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্দিষ্ট ৮নং সেলও ছিল। ইতিমধ্যে বিচার উদ্যোগ আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শুরু হয়েছে নানা তোড়জোড়। শোনা গেলো কারাগারের মধ্যেই আদালত বসবে। সে লক্ষ্যে ডিআইজি প্রিজনের অফিস কক্ষকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ১৮ জুন ভোরে একে একে বিভিন্ন সেল থেকে আমাদের সবাইকে জড়ো করা হলো নবগঠিত ঐ বিচারালয়ে। সেখানে গিয়ে দেখলাম অফিস কক্ষের এক পাশে লোহার গ্রিল দিয়ে একটি বেষ্টনি তৈরি করা হয়েছে। যেখানে তথাকথিত অভিযুক্তরা বসবেন। বেষ্টনির বাইরে একপাশে আইনজীবীদের বসার জায়গা। আর তাদের মুখোমুখি হয়ে বসবেন বিচারকরা।
আদালত কক্ষে দীর্ঘদিন পর দেখা হলো আমার বড় ভাই আবু ইউসুফ এবং ছোট ভাই বেলালের সঙ্গে। তখনকার রাজনৈতিক সাথি মেজর জলিল, আ স ম আব্দুর রব, হাসানুল হক ইনু, ড. আখলাকুর রহমান, মোহাম্মদ শাহজাহানÑএঁরাও আছেন। মেজর জিয়াউদ্দিন, সুবেদার জালাল, নায়েক সিদ্দিক, হাবিলদার হাইসহ সৈনিক সংস্থার বিভিন্ন সংগঠকরাও আছেন। সাংবাদিক কেবিএম মাহমুদ ও তৎকালীন জাসদ ছাত্রলীগ সভাপতি মান্নাকে দেখলাম। আরো ছিলেন যশোরের বিপ্লবী নেত্রী সালেহা ও তাঁর স্বামী রবিউল আলম। দেখা পেলাম না শুধু কর্নেল তাহেরের। জানা গেলো তাহের ভাই এ গোপন বিচারালয়ে আসতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এ নিয়ে ৮নং সেলে কারা কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁর বাদানুবাদ চলছে। পরবর্তী তারিখে আইনজীবীদের কয়েকজনের অনুরোধে তাহের আদালত কক্ষে আসতে রাজি হন।
কয়েকজন আইনজীবীর সঙ্গেও দেখা হলো। এদের মধ্যে ছিলেন বাংলার এককালীন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, পরে বিএনপি নেতা ও রাষ্ট্রদূত জুলমত আলী খান, প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল আমিনুল হক, সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আব্দুর রউফ, অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, কে জেড আলম, আলতাফুর রহমান, সিরাজুল হক, মহীউদ্দিন আহমেদ, শরীফ চাকলাদার, জিন্নাত আলী, খাদেমুল ইসলাম প্রমুখ।
আমাদের পক্ষে আইনি লড়াই চালাবার জন্য এঁদের কেউ কেউ এসেছিলেন কারাগারের বাইরে থাকা জাসদ নেতৃবৃন্দের অনুরোধে। আবার কেউ-বা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই। প্রথমেই আমাদের আইনজীবীদের শপথ নিতে হলো যে বিচারের গোপনীয়তা বেঁধে দেওয়া সময়ের আগে ভঙ্গ করলে কঠিন শাস্তি পেতে হবে তাঁদের।
সামরিক অধ্যাদেশ জারির পরদিন অর্থাৎ ১৬ জুন ১৯৭৬, সরকার নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রে ‘বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইব্যুনাল’ গঠনের খবর বেরোয়। এক নম্বর বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইব্যুনাল নামে পরিচিত এই ট্রাইবুন্যালের চেয়ারম্যান করা হয় ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দারকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই বাঙালি অফিসার ১৯৭১-এ দেশে অবস্থান করেও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেননি, বরং সক্রিয়ভাবে পাকিস্তানিদের পক্ষালম্বন করেছিলেন। আরো ৪ জন সদস্য ছিলেন এই ট্রাইব্যুনালে। এদের মধ্যে ছিলেন বিমান বাহিনীর উইং কমান্ডার মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ও নৌ বাহিনীর কমান্ডার সিদ্দিক আহমদ। বাকি দুজন ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তি, প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আব্দুল আলী ও হাসান মোরশেদ। লক্ষণীয় যে, গোপন সামরিক ট্রাইব্যুনালের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অর্থাৎ ৫ জনের মধ্যে ৩ জনকে রাখা হয় প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে।
সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী বা পাবলিক প্রসিকিউটর ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এটিএম আফজাল, যাঁকে তাহেরের ফাঁসির পর হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। মামলার সাক্ষ্য পরিচালনা করে সে সময়কার স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুর রাজ্জাক খান। সরকার পক্ষেও এই দুই আইনজীবীকে সহযোগিতা করেছিলেন তৎকালীন অ্যাসিসটেন্ট অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী আব্দুল ওহাব।
মামলা সম্পর্কে আমাদের কিছুই জানানো হলো না। যদিও এর আয়োজন চলছে বেশ পূর্ব থেকেই। আমাদের ১৮ জুন আদালত কক্ষে নিয়ে আসার পরই কেবল জানানো হয় ‘রাষ্ট্র বনাম মেজর (অব.) এম এ জলিল গং ষড়যন্ত্র মামলা’র কথা। মেজর জলিল জাসদের সভাপতি হওয়ার কারণেই সম্ভবত তাঁর নামে মামলার নামকরণ। বাস্তবে মামলার মূল লক্ষ্য ও আসামি ছিলেন কর্নেল আবু তাহের। মোট ৩৩ জনকে আসামি করা হয়, যাঁদের মধ্যে ১২ জন ছিলেন বেসামরিক ব্যক্তি।
আদালত কক্ষে নেওয়ার পূর্বে গোয়েন্দা বিভাগের লোকজন কারাগার কার্যালয়ের এক কক্ষে আমাদের বসায়। তারপর রাজসাক্ষীদের চেনাতে শুরু করে আমরা কে কোন জন। এটা তারা করেছিল প্রকাশ্যেই কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে। বিচার যে ছিল আসলেই প্রহসন তা প্রাথমিক এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠে।
এরপর ২১ জুন তাহেরসহ আমাদের সকলকে আবার আদালত কক্ষে নিয়ে আসা হয়। দিনটি ছিল ঘটনাবহুল। প্রথমেই আমাদের হাজিরা নেওয়া হয়। নাম ডাকার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উঠে দাঁড়াতে হচ্ছিল। কিন্তু নাম ডাকার পরও ইউসুফ ভাই নির্বিকার বসে রইলেন। কেন তিনি উঠে দাঁড়াচ্ছেন না জিজ্ঞেস করা হয়ে, তিনি বললেন তাঁর সঠিক নাম আবু ইউসুফ খান, বীর বিক্রম ডাকা না হলে তিনি উঠে দাঁড়াবেন না। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে তিনি বীর বিক্রম খেতাব অর্জন করেছেন। কেউ অনুগ্রহ করে এ খেতাব দেননি। শেষ পর্যন্ত তাঁকে বীর বিক্রমসহ পুরো নামেই ডাকা হয়।
এরপর আমাদের আইনজীবীরা সরকারি অভিযোগনামা ও রাজসাক্ষীদের ভাষ্য চাইলেন। রাজসাক্ষীদের সাক্ষ্য সরবরাহ করতে কোর্ট রাজি হলো না। আমরা অত্যন্ত জোরের সঙ্গেই বললাম যে আমরা তা মানবো না। বেশ উত্তপ্ত অবস্থা। কর্নেল তাহের এক পর্যায়ে তাঁর আসন থেকেই উঠে দাঁড়ালেন ও তাহের ওয়াকিং স্টিকটি উঁচিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও কক্ষ ছেড়ে জেলগেটের দিক রওনা হলাম। এটা ছিল এক অভাবনীয় দৃশ্য। আমাদের এ তাৎক্ষণিক দ্রোহে ভীত হয়ে তথাকথিত বিচারকরা পালিয়ে গেলেন। সে সময় জেলগেট এখনকার মত লোহার পাত দিয়ে বন্ধ ছিল না। লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে বাইরে থেকে ভেতরটা দেখা যেতো।
আমাদের প্রথম দিনের এ প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে গোপন এই বিচার প্রহসন সম্পর্কে আমরা বাইরের জগৎকে জানাতে চাচ্ছিলাম। কোর্ট আর বসলো না সেদিন। নিজ নিজ সেলে নিয়ে যাওয়া হলো আমাদের। পরে যখন আবার বিচার শুরু হয়, তখন থেকে আমাদের বিচারালয়ে নিয়ে আসা হলো খালি পায়ো ও হাকড়া পরিয়ে। আমাদের বসার জায়গায় যে লৌহ বেষ্টনি, তাতে তালা দেবারও ব্যবস্থা হয়। উপরন্তু সে বেষ্টনিকে কাঁটাতার দিয়ে মুড়ে দেওয়া হয়।
আমাদের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিলÑবেআইনিভাবে বৈধ সরকারকে উৎখাত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত ছিলাম আমরা। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে নাশকতামূলক রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতা চালানোর দায়েও অভিযুক্ত করা হয় আমাদের।
মামলা চলাকালে বিদ্যমান আইনের পরিপন্থী নানা কাজই জিয়া সরকার করেছে। বিচারে ন্যূনতম নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য ট্রাইব্যুনালে বিচার বিভাগ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য নেওয়া উচিত হলেও তা করা হয়নি। ট্রাইব্যুনালকে প্রদত্ত ক্ষমতার পরিধিও ছিল ব্যাপক। সাধারণ আইন, সশস্ত্রবাহিনী এবং সামরিক আইনের বিরুদ্ধে অপরাধÑএমন সব সামরিক-বেসামরিক অপরাধের বিরুদ্ধে বিচারের ক্ষমতা পায় ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের সামরিক অধ্যাদেশ ১৫ জুন জারি হলেও ঐ একই দিনে ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করেন। তাতে মনে হয় যে, অধ্যাদেশ জারির পূর্বেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। আসলে ১২ জুন তারিখ থেকে ওপর মহলের নির্দেশে ডিআইজি প্রিজনের অফিস কক্ষটি খালি করে গোপন আদালত কক্ষ হিসেবে তৈরি করা হচ্ছিল। এ সব থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে তথাকথিত বিচার ছিল পূর্বপরিকল্পিত সাজানো মহড়া। আমাদের দ- ছিল পূর্বনির্ধারিত।
কারাগারের অভ্যন্তরে অস্ত্রধারী প্রহরী থাকতে পারে না। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল তার ব্যতিক্রম। জিয়া কর্তৃক সে সময় নবগঠিত সশস্ত্র আর্মড ব্যাটেলিয়নকে ঐ সময় কারাভ্যন্তরে আনা হয় আমাদের পাহারা দেওয়ার জন্য। এ বিষয়টি ছিল খুবই ভয়াবহ ও আতঙ্কের। কারণ ’৭৫ এর ৩ নভেম্বর এই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরেই সশস্ত্র খুনিরা পৈশাচিকভাবে হত্যা করেছেন ৪ জন জাতীয় নেতাকে। বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রে সজ্জিত বুটধারী প্রহরীরা আলো-আঁধারিতে আমাদের সেলগুলোর সামনে সেন্ট্রি ডিউটি করতো। আর বিনিদ্র রজনী পার হতো আমাদের।
এ ছাড়া কারাগারে এবং কারাগারের বাইরে ঘনবসতিপূর্ণ ঐ এলাকায় বিভিন্ন বাড়ির ছাদে মেশিনগান পোস্ট বসানো হয়। এমনকি কারাভ্যন্তরে আমাদের আদালত কক্ষের দরজা-জানালার বাইরেও হাল্কা মেশিনগানের পাহারা বসানো হয়। বলা বাহুল্য যে, এসবই ছিল বেআইনি। তথাকথিত বিচারকদের এসব বারবার স্মরণ করিয়ে দেন আমাদের আইনজীবীরা।
বিচারে প্রধান রাজসাক্ষী ছিল কর্পোরাল ফখরুল আলম। এ ছাড়া ছিল হাবিলদার বারী, সুবেদার মাহবুব, হাবিলদার শাহাদৎ আলী প্রমুখ। ফখরুল ছাড়া বেশির ভাগ সাক্ষীর ওপর কঠিন নিপীড়ন চালিয়ে সরকার বাধ্য করেছিল আমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে। ঐ সব সাক্ষীর চোখÑমুখের অভিব্যক্তিই বলে দিচ্ছিলো যে তাঁরা ছিল নিরুপায়।
যারা এ গোপন মামলা সাজিয়েছিল তাদের কথা মতোই সাক্ষীরা সাক্ষ্য দিচ্ছিল। যার মধ্যে মিথ্যাচার আর গরমিলের ছিল ছড়াছড়ি। যেমন রাজসাক্ষী ফখরুল এক পর্যায়ে বলে যে, ড. আখলাকুর রহমানের মোহাম্মদপুরস্থ বাসায় সে কর্নেল তাহেরকে দেখেছে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার ভোরার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে। অথচ বাস্তবে ড. আখলাকের বাসায় কোনো ফোনই ছিল না। এ ধরনের জাজ্বল্যমান অনেক মিথ্যাচারেই অভিযুক্ত হয়েছিলাম কর্নেল তাহেরসহ আমরা। আমাদের আইনজীবীরা রাজসাক্ষীদের বক্তব্যের অসারতা প্রমাণ করবার পরও মামলার ফলাফল প্রভাবিত হয়নি। মামলাটি যথাযথভাবে সাজানোরও প্রয়োজন বোধ করেনি সরকার। স্বাভাবিকভাবে গোটা বিচারকেই অবজ্ঞা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম আমরাÑতথাকথিত অভিযুক্তরা। বিচারকদের প্রতি হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করা হতো আমাদের পক্ষে থেকে। আবার ষড়যন্ত্র থেকে বেরিয়ে আসার আহ্বানও জানানো হতো তাদের প্রতি। যেমনটি করেছিলেন কিউবার ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাঁর জবানবন্দিতে।
সে সময় ১৯৫৩ সালে সামরিক একনায়ক বাতিস্তার বিরুদ্ধে মানকাডা দূর্গ অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর হাসপাতালের একটি কক্ষে ক্যাস্ট্রোর বিরুদ্ধে গোপন বিচার চলছিল। সব দিক থেকেই অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যাবে এ দুটো বিচার প্রহসনের। পার্থক্য এখানেই যে বাতিস্তার রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে কিউবায় বিচারক ন্যায় ও সত্যের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। আর বাংলাদেশে ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দার ও সরকারি পিপি মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেন না।
কিউবা ও বাংলাদেশের বিচারকরা পুরস্কৃত হয়েছিলেন তাদের কর্মের জন্য। বিচারের ছয় বছর পর জেনারেল বাতিস্তার পতন হলে বিজয়ী ফিদেল ক্যাস্ট্রো তাঁর গোপন বিচারের সেই বিচারককে সম্মানিত করেছিলেন বিপ্লব পরবর্তী কিউবার প্রথম রাষ্ট্রপতি হিসাবে তাঁকে নিয়োগ করে। আর বাংলাদেশে গোপন ষড়যন্ত্র মামলায় ক্রীড়নক বিচারপতি ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দারকে পুরস্কৃত করা হয় সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ দূতাবাসে তাকে ট্রেড কমিশনার করে এবং পিপিকে হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করে।
গোপন বিচারে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বৈধ সরকারকে উৎখাতের অভিযোগ এনেছিল জিয়া সরকার। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন ওঠে, কোন বৈধ সরকারকে উৎখাত করেছি আমরা? আমাদের কৌঁসুলি আতাউর রহমান খান, আমিনুল হক, জুলমত আলী খান, আব্দুর রউফ, গাজীউল হক প্রমুখ বারবার এ ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন। সরকারি পিপিকে তাঁরা বলেন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবকে হত্যা করে বৈধ সরকারকে উৎখাত করেছিল রশিদ-ফারুক চক্র, বর্তমান অভিযুক্তরা নয়। সেই বৈধ সরকারকে ষড়যন্ত্র ও হত্যার মধ্য দিয়ে যারা উৎখাত করেছে, তাদের বিরুদ্ধে জিয়া সরকার তো কোনো অভিযোগ উত্থাপন করেনি। বরং হত্যা ও উৎখাতের সঙ্গে জড়িত খুনিদের পুরস্কৃত করেছে।
খুনি মুশতাক সরকার কি বৈধ সরকার ছিল? সে সরকারকেও উৎখাত করেনি তাহের ও তাঁর সহযোগীরা। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ কার্যত কোনো সরকারই ছিল না। আমাদের কৌঁসুলিরা যুক্তি দিয়ে বলেন, সরকারি অভিযোগের বয়ান ও রাজসাক্ষীদের ভাষ্যে এটা পরিষ্কার যে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে পরিচালিত সিপাহি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়েই বন্দী জিয়ার জীবন রক্ষা হয় এবং কার্যত তিনিই সরকার গঠন করেন। অভ্যুত্থান পরিচালনা কি একটি বৈধ সরকারকে উৎখাতের প্রচেষ্টা বলে গণ্য হবে? যদি তাই হয়, তাহলে কেন জিয়া সরকার ৭ নভেম্বরকে বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করেছে? সুতরাং তাহের ও তাঁর সহযোগীদের তো ঐ কাজের জন্য অভিযুক্ত করা যায় না। বরং সিপাহি অভ্যুত্থানের স্থপতি তাহেরকে পুরস্কৃত করার কথা।
আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল প্রতিরক্ষা বাহিনীর অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির। আমাদের আইনজীবীরা উল্লেখ করলেন যে, ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে রশিদ-ফারুকের ক্যুদেতা ছিল প্রতিরক্ষা বাহিনীতে শৃঙ্খলা ভঙ্গের বড় নজির। এ ব্যাপারে জিয়া সরকার কি কিছু বলেছেন?’ ৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকে ৬ নভেম্বর পর্যন্ত সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিরাজমান নৈরাজ্য ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের সঙ্গে তো তাহের ও তাঁর সহযোগীরা জড়িত নন। কিন্তু সামরিক বাহিনীর প্রধান হয়েও সুযোগ থাকা সত্ত্বেও জিয়া সে সমস্ত শৃঙ্খলা ভঙ্গের ঘটনার বিরুদ্ধে কোনো অবস্থান নেননি। তাহের তাঁর ঐতিহাসিক জবানবন্দিতে ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনিই সিপাহি অভ্যুত্থান পরিচালনা করেছেন। যার মধ্য দিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বিরাজমান প্রাসাদ ষড়যন্ত্র ও বিশৃঙ্খলার অবসান সূচিত হয়েছিল। তাহের বললেন যে, বাংলাদেশের নতুন মীরজাফর জিয়া সিপাহি অভ্যুত্থানের লক্ষ্যের সঙ্গে বেঈমানি করে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নতুন করে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছেন। তাহেরের কথা কত যথার্থ ছিল তার প্রমাণ মেলে পরবর্তীকালে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে সংগঠিত অসংখ্য ক্যুদেতার ঘটনা থেকে। এ সমস্ত ঘটনায় হাজার হাজার সৈনিককে কোনো সুষ্ঠু বিচার ছাড়াই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু নির্মম পরিহাস হলো এই যে, এমনই একটি ক্যুদেতায় নিজের জীবন দিতে হয় তাকে।
সমস্ত সওয়াল-জবাবের পর অভিযুক্তদের জবানবন্দি প্রদানের প্রশ্ন এসেছিল। প্রথমে আমরা ঠিক করেছিলাম আমরা জবানবন্দি দেবো না। কি-ই বা লাভ তাতে। কিন্তু আইনজীবীদের অনুরোধে জবানবন্দি দেন সবাই। আমাদের বক্তব্য ধৈর্য ধরে শোনার কোনো ইচ্ছা সামরিক আদালতের ছিল না। কোর্ট থেকে বার বার তাগাদা দেওয়া হচ্ছিল জবানবন্দি সংক্ষিপ্ত করার।
সবার শেষে তাহের ক্রাচে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। আমরা এবং কোর্টের সবাই শুনলাম এক ঐতিহাসিক জবানবন্দি। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দার বার বার বাধা দেন তাহেরের বক্তব্যে। মনে হচ্ছিল ঐ বিচারকরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ছে তাহেরের কথা শুনে। সংক্ষিপ্ততম সময়ে তাহেরের জবানবন্দি শেষ হোকÑএই তারা চাইছিল। অন্যদিকে আমরা সকলসহÑঅভিযুক্ত, আইনজীবীবৃন্দ ও এমনকি সশস্ত্র প্রহরীরা সম্মোহিতের মতো তাহেরের শেষ কথা শুনি। বাঙালি জাতির গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ, সাধারণ মানুষের বীরত্বগাথা, স্বাধীন বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ার পথে অবস্থিত সেনাবাহিনীর প্রতিবন্ধকতা, গণবিচ্ছিন্ন এই বাহিনীর স্থলে জনগণের উৎপাদনশীল গণবাহিনী গড়ে তোলার অনস্বীকার্য প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি তুলে ধরেন তাঁর বক্তব্যে। সাতই নভেম্বর সিপাহি জনতার অভ্যুত্থানের মূল লক্ষ্যই যে ছিল তার বাস্তবায়নÑতাও তিনি ঘোষণা করেন।
অমোঘ বাণীর মতো কিছু কথা উচ্চারিত হয় তাহেরের জবানবন্দির শেষ অংশে। সে সব উদ্দীপনাময় উচ্চারণের বাংলা অনুবাদ অনেকটা এ রকমÑ‘বাংলাদেশের মানুষ বীরের জাতি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই জাতি মরে যেতে পারে না। সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থান এ জাতিকে অদম্য সাহস যোগাবে। এ অভ্যুত্থান থেকে যে শিক্ষা ও দিক নির্দেশনা তারা পেয়েছে তা ভবিষ্যতে তাদের পথ দেখাবে। আমি ভীত নই। আমার দেশ ও জাতিকে আমি ভালোবাসি। এ জাতির অস্তিত্বে আমি মিশে রয়েছি। কার সাহস আছে আমাদের আলাদা করার। নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে জীবনে আর কোনো বড় সম্পদ নেই। আমি তার অধিকারী। আমি আমার জাতিকে তা অর্জন করতে ডাক দিয়ে যাই’।
বিনা প্রস্তুতিতে বলা তাহেরের সেই জবানবন্দি ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত হয় বিদেশে। মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফৎশুলজ তা প্রকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, তৎকালীন বাংলাদেশ সামরিক রাষ্ট্র প্রশাসনের ভেতরকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কোনো একজনের কাছ থেকে তাহেরের জবানবন্দি তিনি পান।
১৯৭৩-১৯৭৪Ñএর বন্যা ও দুর্ভিক্ষের কঠিন দিনগুলোতে প্রথম এই সাংবাদিক তাহেরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কয়েকজন বাঙালি সাংবাদিক তাঁকে জানিয়েছিলেন যে আবু তাহের নামে একজন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসার বন্যা নিয়ন্ত্রণের উপর এক প্রবন্ধ লিখেছেন সাপ্তহিক বিচিত্রায়। উৎপাদনশীল সেনাবাহিনীর ধারণাও তিনি তুলে ধরেছেন সে প্রবন্ধে। পরবর্তীকালে ৭ নভেম্বরের তাঁর লিখিত বইয়ের বাংলা সংস্করণের ভূমিকায় লিফৎশুলজ বলেন, “প্রথম যখন আমি বন্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে তাহেরের সঙ্গে আলাপ করতে গেলাম, তখন আমার কোন ধারণাই ছিল না যে তিনি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত। জানতামই না তিনি নেপথ্যে যে প্রস্তুতি নিচ্ছেন, তাই প্রকাশ পাবে ৭ নভেম্বরে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থানে।” অভ্যুত্থান সংগঠনের সাতদিন পর ঢাকায় পৌঁছে তিনি জানলেন তাহের এই অভ্যুত্থানের স্থপতি। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের ছোট ভাই চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক জুনাবুল ইসলামের (প্র্রয়াত) বাসায় তাহেরের সঙ্গে আবারও সাক্ষাৎ হয় লিফৎশুলজের। আমার বড় ভাই আবু ইউসুফ সে বৈঠকের ব্যবস্থা করেন। ততদিনে জিয়ার প্রতিবিপ্লবী তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। হংকং থেকে প্রকাশিত ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’ পত্রিকায় লিফৎশুলজের পাঠানো রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। তাহেরের ছবি ছাপা হয় তাতে। তার নিচে লেখা হয়-নভেম্বর বিপ্লবের স্থপতি। ঢাকা কারাগারে আমাদের বিচার চলাকালেও তিনি ঢাকায় আসেন। কিন্তু সরকার অতি শিগগির তাঁকে দেশ থেকে বের করে দেয়। আজ এ প্রসঙ্গে এ কথা বলতে চাই যে লরেন্স লিফৎশুলজের লেখা এ সমস্ত প্রবন্ধ ও তাহেরের ওপর তাঁর লেখা বইটি বিদেশ থেকে প্রকাশিত না হলে বাংলাদেশের বোদ্ধাসমাজ হয়তো বিশ্বাসও করতো না যে তাহের ও জাসদ ৭ নভেম্বর সিপাহী জনতার বিপ্লব অভ্যুত্থান সংগঠিত করেছিলেন আর জিয়া সংগঠিত করেছিলেন প্রতিবিপ্লব। ১৭ জুলাই মামলার রায় পড়ে শোনান ইউসুফ হায়দার। প্রথমে ঘোষিত হয় ড. আখলাকুর রহমান, সাংবাদিক কেবিএম মাহমুদ, মোহাম্মদ শাহজাহান, শরীফ নূরুল আম্বিয়া, মাহমুদুর রহমান মান্নানসহ ১৩ জন খালাসপ্রাপ্তের নাম। আ স ম আব্দুর রব, হাসানুল হক ইনু ও আমার ১০ বছর সশ্রম কারাদ- ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা। এভাবেই এক পর্যায়ে নাম এলো মেজর এম এ জলিল ও আবু ইউসুফের। বলা হল যে, তাঁদের নির্ধারিত শাস্তি মৃত্যুদ- হলেও মুক্তিযুদ্ধে তাঁদের অবদানের জন্য তা মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয়া হলো এবং তাঁদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে। আমরা বুঝে ফেলি কর্নেল তাহেরের জন্যে কী শাস্তি নির্ধারিত হতে যাচ্ছে। বিচারক ঘোষণা করলেন যে, কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদ- দেওয়া হলো, ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তা কার্যকর করা হবে। রায় পড়া শেষ করেই বিচারকবৃন্দ অনেকটা দৌঁড়ে আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে যান। রায় শুনে বাদী ও বিবাদী উভয় পক্ষের আইনজীবীরা স্তম্ভিত হয়ে যান। সরকারি পিপি এ টি এম আফজাল (পরে প্রধান বিচারপতি) আদালত কক্ষেই আমাদের আইনজীবীদের জানান যে প্রসিকিউটর হিসেবে তিনি কখনো মৃত্যুদ- দাবি করেননি। তাঁর মতে এ রকম সিদ্ধান্ত ছিল সম্পূর্ণ অবাস্তব। কারণ তাহেরকে যে অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়, তার জন্য মৃত্যুদ- দেওয়া সম্ভব ছিল না-দেশে সে ধরনের কোনো আইনই ছিল না তখন। তাহেরের ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার ১০ দিন পর আইন মন্ত্রণালয় এই আইনগত অসঙ্গতি দূর করে। ৩১ জুলাই আইন মন্ত্রণালয় সামরিক আইনের ২০তম সংশোধনী জারি করে যাতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কোনো ধরনের রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচারের অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদ-’। জানা যায়, তৎকালীন আইন সচিব তাহেরের মৃত্যুদ- সংক্রান্ত রায়ের ব্যাপারে আইনি অসঙ্গতি জিয়াউর রহমানের কাছে তুলে ধরলে জিয়া সে ফাইলটি ছুঁড়ে ফেলে দেন। তিনি নির্দেশ দেন আইন মন্ত্রণালয় থেকে অবিলম্বে এ রায় অনুমোদন দেওয়ার। রায় ঘোষণার পরই আমাদের আইনজীবীরা ঠিক করেন যে, এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে তারা রিট করবেন, যদিও রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিলেরই সুযোগ ছিল না জারি করা সামরিক আইনে। মৃত্যুদ-াদেশ মওকুফের জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে অনুকম্পা চেয়ে আবেদন করারও সিদ্ধান্ত নেন। আদালত কক্ষেই তারা তাহেরের পক্ষে একটি চিঠি তৈরি করে ফেলেন। কিন্তু তাহের তাতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করলেন। তিনি বলেন, ‘মীর জাফরদের কাছে আমার প্রাণভিক্ষা চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।’ তবে মিসেস লুৎফা তাহের স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছে আবেদন করেছিলেন। বাংলাদেশের এই সাবেক প্রধান বিচারপতি সে আবেদনে শুধু সাড়া দেননি তা নয়, তাহেরের মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণার মাত্র একদিনের মধ্যেই তা অনুমোদন করলেন। অথচ বিচারপতি থাকাকালে পূর্ণচন্দ্র ম-ল নামে জনৈক ব্যক্তির ওপর আরোপিত মৃত্যুদ-াদেশ তিনি খারিজ করে দিয়েছিলেন এই যুক্তিতে যে, গুরু অপরাধে অভিযুক্ত একজন অপরাধীর জন্য একেবারে শেষ মুহূর্তে একজন উকিল নিয়োগ লিগ্যাল রিমেমবের‌্যান্স ম্যানুয়াল (১৯৬০)-এর দ্বাদশ অধ্যায়ের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অধিকারকে শুধু লঙ্ঘনই করে না, সেই সঙ্গে ঐ অধ্যায়ে বর্ণিত উদার সুবিধাসমূহের মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ করে দেয়।
তাহেরের বিরুদ্ধে মামলার শুনানি শুরু না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে কোনো উকিলের পরামর্শ নিতে দেওয়া হয়নি। অথচ সায়েমÑযিনি প্রধান বিচারপতি থাকাকালীন সময়ে ¯পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন, পর্যাপ্তভাবে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে আইনের নামে কাউকে মৃত্যুদ- দেওয়া যাবে না, তিনিই সামরিক জান্তার রাষ্ট্রপতি হয়ে তাহেরের মৃত্যুদ-াদেশ বহাল রাখলেন।
রায় ঘোষণার পর সন্ধ্যার আগে আমাদের নিজ নিজ সেলে নিয়ে যাওয়া হলো। তাহেরকে নেওয়া হলো সেই ৮নং সেলে, যা ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্দিষ্ট। রায়ের পরও আমরা ধারণা করছিলাম যে, কর্নেল তাহেরের দ- কার্যকর হওয়ার নয়। একজন ‘বীর উত্তম’ খেতাবে ভূষিত মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার, যার দেহের একটি অংশ উড়ে গেছে মুক্তিযুদ্ধে, তাঁকে কি ফাঁসি দেওয়া সম্ভব? জীবনদাতা তাহেরের প্রতি এমন বিশ্বাসঘাতকতার নজির স্থাপন করবেন জিয়া!
কিন্তু মাত্র একদিনের মধ্যেই আমাদের ভুল ভাঙতে শুরু করে। কারণ রায় ঘোষণার পরদিন থেকেই বহু বছর ধরে অকার্যকর ও অব্যবহৃত হয়ে পড়ে থাকা ফাঁসির মঞ্চ সংস্কারের কাজ শুরু হয়। কেবল তখনই আমাদের কাছে স্পষ্ট হয় যে, এ ফাঁসির আদেশ কাগুজে নয়। জিয়াউর রহমান সত্যি সত্যি কর্নেল তাহেরকে হত্যা করবে।
সে সময় সেনাবাহিনীতে জেনারেল জিয়ার ডানহাত হিসাবে পরিচিত জেনালের মীর শওকত নিজে কারাগারে এসে ফাঁসির মঞ্চের সংস্কার কাজ তদারক করেছিলেন। বলা বাহুল্য যে, এই কাজ তার স্বাভাবিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি তা করেছিলেন এ কারণে যে, তাহেরের প্রতি পুরো সামরিক জান্তা তখন প্রতিহিংসায় উন্মত্ত। আরও একটি কারণ হয়তো এই যে, ১৯৭২ সালে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেলের দায়িত্ব পালনকালে তাহের মীর শওকতসহ আরো কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ কুক্ষিগত করার অভিযোগে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেন। চার বছর পর মীর শওকত তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সুযোগ পেলেন।
তাহেরের প্রাণ বাঁচাতে মিসেস তাহের অনেকের কাছেই গিয়েছিলেন। মাওলানা ভাসানী তাঁর অনুরোধে টেলিগ্রাম পাঠান মৃত্যুদ- কার্যকর না করার অনুরোধ জানিয়ে। প্রেসিডেন্ট সায়েমের কাছে ২০ জুলাই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের জরুরি আপিল তারবার্তা পৌঁছায় তাহেরকে ক্ষমা করার জন্যÑ‘সামরিক আইনের আওতায় জেলের ভিতরে গোপনে অনুষ্ঠিত একটি বিচার জাতিসংঘ ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকারের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানের পর্যায়ে পড়ে না। সর্বোচ্চ আইনগত কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করার অধিকারসহ ফৌজদারি আদালতে আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করা যেতে পারে।’ এই ছিল তারবার্তার ভাষ্য।
রায় ঘোষণার পর থেকে পুরো কারাগার ছিল নিস্তব্ধ। সর্বত্র ছিল শোকের ছায়া। এর মধ্যেই ২০ জুলাই আমাদের তিন ভাইকে এক এক করে ফাঁসির সেলে নেওয়া হয় শেষ সাক্ষাতের জন্য। সবশেষে যাই আমি। সাক্ষাতের ঐ মুহূর্তে তাহেরের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়নি যে, তাঁকে আমরা হারাতে যাচ্ছি। যদিও ইতিমধ্যে আমরা জেনে গেছি যে সেটাই হতে যাচ্ছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক, সাবলীল ও প্রাণবন্ত ছিলেন তাহের ঐ মুহূর্তে। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অবিচলভাবে তাঁর সহযোগীদের মধ্যে তিনি সাহস সঞ্চার করে গেছেন এবং নিজেও ছিলেন সমস্ত শঙ্কা ও ভীতির উর্ধ্বে। তাহের ভাইয়ের ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে এটা জেনেও আমরা মোটেও ভীত হইনি। আমার তখন মনে হচ্ছিল যে, জনগণের সত্যিকার মুক্তির জন্য এ রকম সাহস ও আত্মত্যাগের বোধ হয় বড় প্রয়োজন। এমন একদিন নিশ্চয়ই আসবে, যখন এই আত্মত্যাগ সবাইকে নাড়া দেবে, উদ্বুদ্ধ করবে।
সাক্ষাৎ শেষে নিজ সেলে ফিরে এলাম। সারাদিন স্তব্ধ অপেক্ষায় কাটালো সমগ্র কারাগার। রাতে কারাগারের কোনো বন্দী ঘুমোয়নি। সবারই অপেক্ষা, কখন সাহস আর বেদনায় মোড়ানো ঐ মুহূর্তে আসবে। রাত ১২টার দিকে উজ্জ্বল আলোয় ফাঁসির মঞ্চ আলোকিত হয়ে উঠলো। সে আলোর ছটা দেখা যাচ্ছিলো আমার সেল থেকেও। কারারক্ষীরা জানালো যে ঘাতকরা প্রস্তুত। ভোর রাতে ৪টায় ফাঁসির কার্যকর হলো। তার কিছুক্ষণ পরই একজন কারারক্ষী আমার সেলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পানি পড়ছিল তার চোখ দিয়ে। কিছুই বলতে হলো না তাকে। আমি বুঝে ফেললাম কর্নেল তাহের আর আমাদের মাঝে নেই। তাহেরকে হত্যা করা হয়েছে।

লরেন্স লিফৎশুলজ
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকা- এবং তৎপরবর্তী সংঘাতময় নভেম্বর মাসের ঘটনাবলী অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফৎশুলজ। ১৯৭৪ ও ৭৫ সাল জুড়ে তাঁর কর্মক্ষেত্র ছিল দক্ষিণ এশিয়া। এশিয়া ও ইউরোপের নানাবিধ বিষয়ে তিনি লন্ডনের ‘দি গার্ডিয়ান’ প্যারিসের ‘লা মদে দেপ্লোমাতিকে’ এবং নিউইয়র্কের ‘দি নেশন’Ñএর মতো শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় লিখে থাকেন। বহু গ্রন্থের প্রণেতা লরেন্স লিফৎশুলজ বাংলাদেশকে নিয়ে লিখেছেন ‘বাংলাদেশ: দ্য আনফিনিশড রেভ্যুল্যুশন’। ভোরের কাগজÑএর অনুরোধে ঘটনাবহুল ৭ নভেম্বর উপলক্ষে লরেন্স লিফৎশুলজ নিউইয়র্ক থেকে ই-মেইল প্রতিবেদনে পাঠিয়েছেন তাঁর বিশ্লেষণ।

স্মরণীয় সেই দিন
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর পরবর্তী বছরগুলোয় অনেকেই ফিরে তাকাতে চাইবেন সেই দিনটি বা তার পরের ঘটনাবলীর দিকে, বুঝে উঠতে চাইবেন সেই ঝড়ো হাওয়ার গতিপথ যা হিমহিম সেই হেমন্ত দিনে তাদের জীবনকে নাড়িয়ে দিয়েছিল প্রবলভাবে। সেই সব দিনে সারা বাংলার কারাগারগুলোয় বহু লোক উৎকণ্ঠিত প্রহর গুনছিল, শেষ পর্যন্ত তারা বাঁচতে পারবে কি না। আর প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে তারা, যাদের অনেকেই ছিলেন নির্জন কারাবাসে, ৭ নভেম্বরের কথা ভাবছিলেন। ঐ দিনের প্রতিটি ঘণ্টা, বলা যায়, প্রতিটি মিনিটের কথা কল্পনা করছিলেন।
যখন গোপন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হচ্ছিল, বানানো হচ্ছিল ফাঁসির মঞ্চÑবহু মানুষ তখনও তাদের মনের গভীরে আশা পুষে রাখছিলেন। কেউ কেউ ধৈর্যের সঙ্গে এই বিশ্বাস জাগিয়ে রাখছিলেন যে, বাইরে অবস্থানকারী তাদের কমরেডরা নতুন এক তুমুল আক্রমণে ভেঙে গুড়িয়ে দেবে কারাগারের দেয়াল। কেউ-বা আবার শান্তভাবে আগামী দিনগুলোর সুদীর্ঘ বন্দিত্ব আর দুঃখকষ্টের জন্য মনকে প্রস্তুত করছিলেন। কারাফটকের বাইরে তখন এমন ধারণা বিরাজ করছিল যে, এক অভিনব বিদ্রোহ সংঘটিত হয়েছে, যা উচ্চবিত্ত বাঙালিদের গভীরভাবে সন্ত্রন্ত করে তুলেছে। তারা এর আগে কখনো এমনটা দেখেনি, আর আমৃত্যু লড়াই না করে এ জাতীয় বিদ্রোহ মেনে নিতেও তারা প্রস্তুত নয়।
ঐ দিন যা ঘটেছিল তার সঙ্গে কোনো মিল নেই অতীতের পাকিস্তান আমল বা বাংলাদেশ হওয়ার পরবর্তী বছরগুলোর অন্তর্কলহময় বুর্জোয়া রাজনৈতিক টানাপড়েনের। ঐ দিন সমাজতান্ত্রিক আদর্শের সঙ্গে একাত্মতা পোষণকারী এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত বহু সৈনকি এক ভিন্ন লক্ষ্যকে সামনে রেখে এগিয়ে আসে। পূর্ববর্তী মাসগুলোর অভ্যুত্থান আর রক্তপাতের বিরুদ্ধে ছিল তাদের তীব্র ঘৃণা, যেসব অভ্যুত্থানে সিনিয়র সামরিক অফিসাররা কতোগুলো নিছক রক্ষণশীল কর্মসূচি নিয়ে বিভিন্ন উপদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন (কিংবা জড়িত ছিলেন), এবং বিদেশি গোয়েন্দাদের সঙ্গেও যোগসাজশ ছিল তাদের। ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের উদ্যোগ নিয়েছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জাসদের সশস্ত্র শাখা। এই বিদ্রোহই প্রথম বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবী গণবাহিনীর অস্তিত্বকে প্রকাশ্যে নিয়ে আসে। দুটি সংগঠনই ১৯৭১ সালে মুক্তিবাহিনীর দুর্দান্ত নেতৃত্ব আর সদস্যদের একটি অংশকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল। তাদের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা ছিল তাদের লড়াইয়ের অর্ধেক সাফল্যমাত্র। তাদের বিচারে স্বাধীনতা যদি পাকিস্তান আমলের চিরাচরিত সামাজিক কাঠামোটিই আবার তৈরি করে তবে সেই স্বাধীনতার কোনো মূল্য নেই।
এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের অভ্যুত্থান অংশত পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক উন্নয়নের ফসল। আজিজুর রহমান খান ও কিথ গ্রিফিন আইএলও-এর জন্য তৈরি করা তাদের সমীক্ষায় দেখিয়েছেন, এশিয়ার যেসব দেশে তারা সমীক্ষা চালিয়েছেন, এমনি কি তথাকথিত ‘সফল’ অর্থনীতিগুলোর ক্ষেত্রেও সেসব দেশে অর্থনীতির নাটকীয় প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও নাগরিকদের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রকৃত আয় কোনোভাবেই বাড়েনি। ৭ নভেম্বর বিদ্রোহের ঘটনা যে সময় ঘটছে, আইএলও সে সময় দেখালো যে, যাকে তারা ‘চরম দারিদ্র্যসীমা’ বলে অভিহিত করছে এবং দিনে ১ হাজার ৯৩৫ ক্যালরি গ্রহণকারী হিসেবে তারা যাদের সংজ্ঞায়িত করছে, বাংলাদেশে ঐ ‘চরম দারিদ্র্যসীমার’ নিচে বসবাসকারী লোকের সংখ্যা ১৯৬৩-৬৪ সালের ৪০ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৯৭৩-৭৪ সালে দাঁড়ায় ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশ। আর আরো ভয়ানক যে পর্যায়, যাকে তারা বলেছেন ‘চরমতম দারিদ্র্যসীমা’Ñ১ হাজার ৭২০ ক্যালোরির চেয়ে কম ক্যালরি গ্রহণকারী হিসেবে যে পর্যায়টিকে তারা সংজ্ঞায়িত করেছেনÑঐ একই দশকে (১৯৬৩-৭৩) বাংলাদেশে ঐ ‘চরমতম দারিদ্র্য’ সীমার নিচে বসবাসকারী জনগগোষ্ঠীর সংখ্যা ৫ দশমিক ২ থেকে বেড়ে ৪২ দশমিক ১ শতাংশ দাঁড়ায়।
এই সময়ে এশিয়ার অন্য অর্থনৈতিগুলোর সঙ্গে যেখানটায় বাংলাদেশের অর্থনীতির সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল, তা হলো গড়পড়তা জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত হ্রাস পাওয়া সত্ত্বেও জাতীয় আয়ে সমাজের সম্পদশালী অংশের অংশীদারিত্ব বেড়েই চলছিল। আজিজুর রহমান খান ও গ্রিফিন লিখেছেন, ‘কেমলমাত্র বাংলাদেশেই গড় আয় হ্রাস পেয়েছে অথচ এখানে মজার প্রশ্নটি হলো, গড় আয়ের হ্রাস সত্ত্বেও কিভাবে উচ্চ আয়ের লোকেরা তাদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হলো! এক অর্থে, এশিয়ার বাকি অংশে কী ঘটছে বাংলাদেশ তার সবচেয়ে নাটনীয় দৃষ্টান্ত …এশিয়ার বাকি অংশে গড় আয় বেড়েছে, গরিবরা আরও গরিব হয়েছে, ধনীরা হয়েছে আরও ধনী; আর বাংলাদেশে গড় আয় কমেছে, তবু ধনীরা আরও ধনী হয়েছে আর গড় আয় কমার চেয়েও দ্রুত গতিতে গরিবদের অবস্থার অবনতি হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে বিচার করলে এরকম হতাশাব্যঞ্জক অর্থনৈতিক দৃষ্টান্তকে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভবত অযৌক্তিক বলে মনে করার অবকাশ নেই। ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহ যে প্রশ্নটিকে নাটকীয়ভাবে তুলে ধরেছিল তা হলো ক্রমশ নি¤œগামী এই অর্থনৈতিক দুর্দশার অচলায়তনের হাত থেকে রেহাইয়ের যৌক্তিক পথ ছিল কি ছিল না? থাকলে, কী সেই পথ? একই ঘূর্ণাবর্ত? পৃথিবীর দরিদ্রতম দেশগুলোর একটিতে বিপ্লবী সমাজতন্ত্র কি শেকড় গাড়তে পারবে, নাকি যুক্তরাষ্ট্রের দাক্ষিণ্য আর বিশ্ব ব্যাংকের পরিকল্পনার ওপর ভিত্তি করা পুঁজিবাদী উন্নয়নের পথেই বহাল থাকবে? আমার নিজের মতে, এই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়ানোটাই ছিল ঐ বিদ্রোহের অন্তর্নিহিত তাগিদ, আর রাজনৈতিক শক্তিগুলো ঐ বিদ্রোহেরই চাকাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল। বিদ্রোহ পাশবিকভাবে গুড়িয়ে দেয়, নিষ্পেষিত করে। বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ আর সমর্থকদের পাকড়াও করে বন্দী করা হয়েছিল। কর্নেল আবু তাহেরের মতো মূল নায়কদের গোপনে বিচার করে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।
বাংলাদেশের সচেতন অংশটি, বিশেষত নতুন প্রজন্ম, যারা এখনো দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করেন, এখনো এমন একটি নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন লালন করেন যে সমাজে সামাজিক ন্যায়বিচার আর গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিগুলো সুরক্ষিত থাকবেÑতাদের ক্ষেত্রে দু’দশক আগে সংঘটিত ঘটনাগুলো স্মরণ করা আজ জরুরি। ইতিহাসের এই অধ্যায়ে ছড়িয়ে রয়েছে শিক্ষণীয় অনেক কিছু।
১৯৭৯ সালে আমি একটি বই লিখেছিলাম, ‘বাংলাদেশ: অসমাপ্ত বিপ্লব’ নামে। প্রকাশের পরপরই বইটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়। যে সব ঘটনা ৭ নভেম্বরের অবতারণা করেছিল, আমার ঐ বইটি সেই সব ঘটনা থেকেই উৎসারিত, তবে চূড়ান্ত বিবরণ নয়। তাহেরের গোপন বিচার এবং ফাঁসির পরপরই বইটি লেখা হয়। জেলখানার ভেতর বসানো আদালতে যে সামান্য কয়েকজন তাঁর জবানবন্দি শুনেছিলেন, তাঁরা ছাড়া আর সবার কাছে ট্রাইব্যুনালের সামনে প্রদত্ত তাহেরের ঐ জবানবন্দি গোপন রাখা হয়েছে। তাঁদেরকে সাধারণ আদালতে বিচার করা হয়নি গণমানুষের প্রতিক্রিয়ার ভয়ে আর দশটা মানুষের মতো বিধিসম্মত বিচার তাহেরেরও প্রাপ্য ছিল। আর সবার মতো তাঁরও অধিকার ছিল সুবিচার পাওয়ার। তাঁর কথা জনগণকে শুনতে দেওয়া উচিত ছিল। তাঁর কর্মকা-ের পেছনের যুক্তিগুলো গণমানুষের কাছে ব্যক্ত করার অধিকার প্রাপ্য ছিল তাঁর। তাও তাঁকে দেওয়া হয়নি। বিচারের সময় তাহের যা বলেছেন, জনগণ যদি তা শুনতে বা পড়তে পারতো, তবে কর্তৃপক্ষ তাদের পূর্বপরিকল্পিত মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর করতে পারতো বলে মনে হয় না।
যারা ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেকে সাধারণ সৈন্য ছিলেন। তাদের সাহস, বীরত্ব আর আত্মত্যাগের যে গুণাবলী লক্ষ্য করা গেছে তা ঐ বিদ্রোহের এক বিশিষ্ট উত্তরাধিকার হিসেবে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। আগামী বছরগুলোয় অনেকেই জেল-জুলুমের শিকার হবে, অনেকেই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করবেÑকেননা ঐ বিদ্রোহের প্রভাব এখনো কাটেনি। শুধু তাই নয়, আরেকটি উত্তরাধিকার রয়ে গেছে, দ্বিগুণ প্রচ-তায় যার মুখোমুখি হতে হবে, কেননা এতদিন ধরে তাকে কেবল এড়িয়েই যাওয়া হয়েছে। আর তা হলোÑ৭ নভেম্বরে যে সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তিগুলো সচল হয়েছিল, সেগুলোর পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করে দেখার ব্যাপারে আন্তরিক প্রচেষ্টার অভাব। এ কাজ অবশ্যই একজন বিদেশি সাংবাদিককে দিয়ে হবে না। ঐ বিদ্রোহে অংশ গ্রহণকারীদের তাদের নিজেদের স্মৃতিচারণা ও ভাবনা-চিন্তা প্রকাশ করতে হবে। এ ব্যাপারে যে নীরতবতা দেখা যাচ্ছে, তাকে খুব বেশি প্রলম্বিতই বলা যায়।
৭ নভেম্বরের ঘটনার এমন অনেক দিক আছে যেগুলোর আরও অনুসন্ধান ও আলোচনা প্রয়োজন। যেমন, সবচেয়ে স্বাভাবিক প্রশ্ন হলো বিদ্রোহ যখন দানা বাঁধছে আর ছড়িয়ে পড়ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে ৭ নভেম্বর জিয়া বন্দী অবস্থায় ছিলেন এবং নিজের জীবন রক্ষার্থে তিনি মরিয়া হয়ে মধ্যস্থতাকারীদের মারফত তাহেরের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন যে, তাহের যেন তাকে বের করে নিয়ে আসে। তারপর তাহেরকে জড়িয়ে ধরে একদল সৈন্যের সামনে জিয়া বলেছিলেন যে তাহের তাঁর প্রাণ বঁাঁচিয়েছে। কিন্তু এই কৃতজ্ঞতা ছিল খুবই স্বল্পস্থায়ী।
এই দুই ব্যক্তির মুখোমুখি হওয়া এবং পরবর্তীকালে এদেরই একজনের বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা আসলে আরও গভীরে বিরোধপূর্ণ শক্তিগুলোর সংঘাতের একটা উপরিÑআভাস মাত্র। এখানে খুব জরুরি প্রশ্নটি হলো, এই দু’পক্ষ কেন একটি কৌশলগত সমঝোতায় আসলো! স্পষ্টতই, প্রত্যেক পক্ষই ভেবেছে, তারা তাদের স্বার্থে, সাময়িকভাবে হলেও, অন্য পক্ষকে ব্যবহার করতে পারবে। জাসদের প্রেক্ষিত থেকে এই বিদ্রোহের সময় নির্ধারণ এবং মনে পড়ার পেছনে ধারণাটি কী ছিল? তাছাড়া এর পেছনে সার্বিক কলাকৌশল এবং এর লক্ষ্যই বা কী ছিল?
জাসদ জিয়াউর রহমান সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করেছিল তা বিপর্যয়কর রকম ভুল ছিল। তবে এটা বলা যায় যে, জিয়া তার শ্রেণীগত অবস্থান থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারবেন এবং তৃতীয় বিশ্বের অভিজাতসুলভ শাসনামলে সামরিক অফিসারদের অঢেল সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার যে চিরাচরিত রেওয়াজ তাও অস্বীকার করতে পারবেনÑসত্তর দশকের প্রথমদিকে এবং মধ্যভাগে এরকম বিশ্বাস করার পেছনে কিছু ভিত্তি ছিল। জিয়ার সঙ্গে নিয়মিত লিয়াজো রক্ষার দায়িত্বে ছিলেন জাসদের এমন এক নেতার মতে: “আমরা তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছিলাম। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় সহযোদ্ধা হওয়ায় এই যোগাযোগ আরও জোরদার হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধের ডামাডোলে প্রতিরোধ তৈরির ক্ষেত্র আমাদের একত্রিত করেছিল। যুদ্ধের আকস্মিকতায় ভবিষ্যতের মত-পার্থক্যগুলো চাপা পড়ে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর আমরা জিয়ার ব্যাপারে মূল্যায়ন করে বুঝতে চাচ্ছিলাম কোনো পর্যায়ে তিনি প্রগতিশীল ভূমিকা পালন করতে পারবেন কি-না। ১৯৭০Ñএর দশকের শুরুর দিকে সংকট ঘনীভূত হওয়ার সময় এবং ১৯৭৪Ñ৭৫-এর দিকে আমরা যখন সময়টাকে বিপ্লবের প্রস্তুতিকাল হিসেবে পরিণত বলে বিবেচনা করছি, তখন আমি ছাড়াও তাহের জিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছিলেন।”
“জিয়া সম্পর্কে আমাদের হিসাব-নিকাশে যদি ভুল হয়েই থাকে, তাহলে সেটা এ জন্য নয় যে, না বুঝেÑশুনেই হয়েছে। তার সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়নের কিছু ভিত্তি ছিল। একটা দৃষ্টান্ত দেই। ১৯৭৪ সালের এক সন্ধ্যায় আমি যখন তার ক্যান্টনমেন্টের বাসায় বসে কথা বলছিলাম, জিয়া আমাকে ১৯৬০-এর দশকে তার এক ভ্রমণের গল্প শোনালেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের এক সিনিয়র সামরিক অফিসারকে নিয়ে নৌকা ভ্রমণে বেরিয়েছেন। এক সন্ধ্যায় তারা যখন অর্ধাহারে ক্লিষ্ট, শতচ্ছিন্ন বস্ত্র পরিহিত স্থানীয় লোকদের একটি দল তাদের দিকে এগিয়ে এলো। আমাদের দেশে এতো আর নতুন কোনো দৃশ্য নয়। এসব দৃশ্য কে না দেখেছে? তবে পশ্চিম পাকিস্তানের বেশিরভাগ এলাকায় জীবন এতটা দুর্দশাগ্রস্ত ছিল না। এই চরম হতদরিদ্র অবস্থা দেখে তার সিনিয়র অফিসার বেশ বিচলিত হলেন।”
“এই দরিদ্র লোকদের দুর্বিসহ জীবনে পরিবর্তন আনতে কী করা যায় এ নিয়ে জিয়া আর তার ঊর্ধ্বতন অফিসারের মধ্যে আলোচনা হলো। জিয়া সাবধানে সে সময়ের বহুচর্চিত জাতীয়তাবাদের কথা তুললেন। বললেন, জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠতার কারণ অর্থনৈতিক উন্নয়নের খাতিরে জাতীয় সম্পদে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য হিস্যা থাকা দরকার। তারপর জিয়া আমাকে বললেন, তবু দেখুন, ঐসব অনাহারি লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে আমার এও মনে হলো, এটা কেবল জাতীয়তাবাদেরই প্রশ্ন নয়। আমি বুঝতে পারলাম আমাদের এই পরিস্থিতিতে একমাত্র সমাজতন্ত্রই এইসব মানুষের দুর্দশার পরিবর্তন ঘটাতে পারে।”
“এ জাতীয় কথাবার্তার কারণেই আমরা ভেবেছিলাম, প্রয়োজনীয় পরিস্থিতিতে জিয়া হয়তো ‘প্রগতিশীল’ ভূমিকা পালন করবেন। এটা শুধু আমার মূল্যায়নই ছিল না, তাহেরেরও ছিল। তাহের আমার চেয়ে তাকে ভালো চিনতো। তবে এখন প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, আমাদের এই ধারণা একটা বড়ো ভুল ছিল।”
১৯৭৪Ñ৭৫ সালের দ্বন্দ্ব-সংঘাতময় দিনগুলোতে জিয়া খুবই দুর্বোধ্য একটি চরিত্র ছিলেন। সম্ভবত তিনি নিজেও জানাতেন না তার জীবন এবং অঙ্গীকার কোন পথে প্রবাহিত হবে। যখন সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এলো, জিয়া পরিচিত, চিরাচরিত পথটিই বেছে নিলেন।
তবে, জিয়াউর রহমানের আচরণের প্রশ্নই যদি একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তাহলে ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহ যে ইস্যুগুলোকে সামনে নিয়ে এসেছিল তা গভীরভাবে খতিয়ে দেখা যাবে না। মনোযোগ শুধু এক্ষেত্রেই কেন্দ্রীভূত করলে গভীর বিশ্লেষণ এড়িয়ে যাওয়া হবে। ৭ নভেম্বরে জাসদ যদি সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতো তাহলে নিশ্চয়ই তাদের কিছু আপাতকালীন প্রস্তুতিও থাকতো। কিন্তু তা তাদের ছিল না। কেন ছিল না সেটা বিশেষত জাসদের অভ্যন্তরে যারা বামঘেঁষা তাদের মনে বেশকিছু কঠিন এবং বিতর্কিত প্রশ্নের জন্ম দেয়। যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদের বেশিরভাগই কখনো সরাসরি এসব প্রশ্নের মুখোমুখি হননি।
সাংবাদিক হিসেবে যখন প্রথম এইসব ঘটনার রিপোর্ট করা শুরু করি তখন থেকেই আমি অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের সাক্ষাতকারের ভিত্তিতে ঐ সময় কী ঘটেছিল তা খতিয়ে দেখার চেষ্টা করে আসছি। অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে যারা জীবিত ছিলেন তারা দুঃসহ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরই এটা সম্ভব হয়। কিন্তু এ কাজের জন্য যে ধরনের গবেষণা প্রয়োজন তা করার মতো অবস্থা আমার নেই। যারা আরও ভালো অবস্থায় আছেন, তাদেরই কারো এটা করা উচিত। সম্ভব হলে নিজের কাজকে বৈধ বলে জাহির করার খ-িত, সংকীর্ণ সীমানা অতিক্রম করে এ কাজ করা উচিত। এখানেই প্রয়োজন ঐতিহাসিকের প্রতিভা।
আমি, যা হোক, কয়েকটি আপাত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। আমি ‘আপাত’ শব্দটার ওপর জোর দিচ্ছি। প্রায়শই প্রশ্ন করা হয়, ৭ নভেম্বরে ফুঁসে ওঠা ঐ বিদ্রোহ জাগিয়ে দেওয়ার পেছনে জাসদের মূল লক্ষ্য কী ছিল? আমার ধারণা হলোÑতারা বুঝতে পেরেছিল সাংগঠনিক দিক থেকে তারা ক্ষমতা দখলের উপযোগী অবস্থায় নেই। নিজেদের শক্তিকে এতটা বাড়িয়ে দেখার মতো বোকা তারা ছিল না। তাদের অনেক ক্যাডার ও কর্মীই তখন কারাগারে। আমি যতদূর তথ্য জোগাড় করতে পেরেছি তাতে জানা যায়, জাসদ নেতৃবৃন্দ বিশ্বাস করতেন যে, তারা নিজেদের জন্য একটি বড় ধরনের সূত্রপাতের প্রথম দফার কাজ শুরু করার মতো অবস্থানে রয়েছেন, যা পরবর্তীকালে সংহত করা সম্ভব হবে।
৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের উদ্দেশ্য ছিল কারাগার থেকে তাদের নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকদের মুক্ত করা, তারপর এস্টাবলিশমেন্টের শরিক হওয়া এবং রাজনৈতিক এবং সামরিক ক্ষমতার সমান্তরাল কেন্দ্র তৈরি করা। জাসদ মনে করছিল যে, আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান না করেও ঘটনাপ্রবাহর গতিপথ নিয়ন্ত্রণ করার মতো যথেষ্ট ওজন তাদের আছে।
এ অবস্থায় জাসদ তার গণসংগঠনগুলোকে সক্রিয় করা এবং সেনানিবাসে অনুগত সামরিক কমিটি গঠন করার মাধ্যমে নিচ থেকে এক ধরনের ‘আধিপত্য’ তৈরি করতে চেয়েছিল। এ সময় জাসদ অত্যন্ত সক্রিয় ছিল। তারা আন্দাজ করেছিল সমর্থনের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক ভিত্তি তারা প্রসারিত করতে পারবে। এদিক দিয়ে দেখলে অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে মৈত্রীর কৌশল অনুসরণের ব্যাপারে তারা প্রস্তুতই ছিল, যা সমাজতান্ত্রিক লক্ষ্য পূরণের উপযোগী একটি রাষ্ট্র তৈরির ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় শর্ত। এটা হতে পারতো ঐ বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায়, যার জন্য হয়তো কয়েক মাস সময় লাগতো, আর এ সময়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন অস্থায়ী সরকার ক্ষমতায় থাকতো।
কিন্তু ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে প্রশ্ন জাগে, ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহের সময় তাদের সাংগঠনিক প্রস্তুতি, জাসদের দৃষ্টিকোণ থেকে, বিদ্রোহের ন্যূনতম লক্ষ্য পূরণের উপযোগী ছিল না। এ প্রশ্নের বহু দিক রয়েছে এবং তা ঐ বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে নিঃসন্দেহে এক বিতর্কের বিষয়বস্তু হয়ে থাকবে চিরকাল। তাঁর গ্রেপ্তার হওয়ার সপ্তাহখানেক আগে, ১৫ নভেম্বর, আমি যখন তাহেরের সঙ্গে দেখা করি, তিনি এই বিষয়টি নিয়েই পর্যালোচনা করেছিলেন। এই সংকট সম্পর্কে রিপোর্ট করতে আমি তখন ভারত থেকে ঢাকায় এসেছি। প্রায় এক বছর ধরে তাহেরের সঙ্গে দেখা নেই। যে মানুষটা একদা আমাকে প্রাচীন বাংলার সেচ ব্যবস্থার ইতিহাস এবং আধুনিক বন্যা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার খুঁটিনাটি জটিলতা, ধৈর্য সহকারে বুঝিয়েছিলেন, আমি হঠাৎ করে দেখলাম তিনি এখন এক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের নায়ক।
তাঁর সঙ্গে আমার আলোচনায় তাহের জোর দিয়ে বললেন, ঘটনার গতিধারাই তাদেরকে আগেভাগে অ্যাকশনে যেতে বাধ্য করেছে। তিনি বললেন, তাদের নিজেদের হিসাব-নিকাশ অনুযায়ী একেবারে আটঘাট বেঁধে প্রস্তুত হওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছতে, প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে ১৯৭৬ সালের মার্চ বা এপ্রিল পর্যন্ত সময় লেগে যেত। অর্থাৎ আরও ছয় মাস। ছয় মাস অপেক্ষা করলে ততোদিনে শহরে এবং গ্রাম এলাকায় তারা তাদের জনসমর্থন নতুন করে সাজাতে পারতেন। এর আগের বছর জাসদের কর্মী ও সমর্থকদের ব্যাপকহারে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
তাহের যুক্তি দেখালেন, একটার পর একটা অভ্যুত্থান আর পাল্টা-অভ্যুত্থান সশস্ত্র বাহিনীকে গভীরভাবে অস্থির করে তুলেছিল। এর কারণ, সবাই বুঝে গেছে সামরিক বাহিনীর যে, সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে একপক্ষের ওপর আরেক পক্ষের বাড়তি সুযোগ-সুবিধাই কেবল প্রতিষ্ঠিত হয়, দেশের যে হতদরিদ্র সিংহভাগ মানুষ, তাদের ক্ষেত্রে তা কোন মৌলিক পরিবর্তন আনে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমিল্লা ব্রিগেডের মাধ্যমে তিনি বারবার যে বাণীটি প্রচার করতেন তা হলোÑএকজন সৈন্যের পক্ষে দেশপ্রেমের প্রকৃত অর্থ হলো সবকিছুর ঊর্ধ্বে সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত শ্রেণীটিকে তুলে ধরা। বাংলাদেশের মতো বিশ্বের এক দরিদ্রতম দেশে এই বাণী সামরিক বাহিনীর রাজনীতি সচেতন অংশটির মধ্যে বিপুলভাবে জায়গা করে নিয়েছিল।
এই রাজনীতি সচেতন শক্তিটিই তাহের এবং জাসদকে বিদ্রোহে নেমে পড়তে চাপ দিয়েছিল। নিঃসন্দেহে, এমনকি তুখোড় পর্যালোচনা সত্ত্বেও, তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। মনে করা হচ্ছিলো, তারা অংশগ্রহণ করুন আর নাই করুন একটি বিদ্রোহ অত্যাসন্ন। জাসদের সামনে তখন এ বিদ্রোহে ভ্যানগার্ড হিসেবে অবতীর্ণ হওয়ার অথবা না হওয়ার প্রশ্ন। তারা তখন ভ্যানগার্ড হওয়ার মতো উপযোগী অবস্থানে ছিল। ফলে তারা বিদ্রোহের সঙ্গে জড়িত থেকে পথনির্দেশ দিয়েছে। সম্ভবত তারা এমন এক সমাজে বসবাস করতে করতে অধৈর্য হয়ে পড়ছিল যেখানে সমাজতন্ত্রের বুলি আওড়ানো লোকেরা শেষ পর্যন্ত আরামকেদারায় দোল খায়, না হলে বাজারে চায়ের স্টলে বসে আলোচনার ঝড় তোলে।
তবে প্রশ্ন থেকে যায়Ñএকটা সফল বিদ্রোহের জন্য যে সব দুরূহ এবং জটিল দায়িত্ব কাঁধে নিতে হয়, তা নেওয়ার মতো যথেষ্ট পরিমাণে প্রস্তুত তারা ছিলেন কি না। কেউ কেউ বলেছেন, তারা সে অবস্থানে ছিলেন না এবং সকল প্রকার চাপ সত্ত্বেও তাদের উচিত ছিল নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং অপেক্ষায় থাকা। যেখানে জীবন-মরণ প্রশ্ন জড়িত সেখানে ইতিহাস একবারই সুযোগ দেয়। এরকম কাজে পূর্ণ প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও সময়ের হেরফেরে যেকোনো কিছুই ঘটে যেতে পারে।
ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে ১৫ নভেম্বর তারিখে তাহের জানান, অভ্যুত্থানের সময় নির্ধারণের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুবই জটিল ছিল। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলোর জোটবদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা ছিল এবং তারা অভ্যুত্থানের সমর্থকদের খতম করার অভিযানে নামতে পারতো। প্রতিশোধ স্পৃহার অভিপ্রকাশ হিসেবে পরবর্তী তিন বছরে বস্তুত সেটাই ঘটেছে। অপরিণত ও অপর্যাপ্ত প্রস্তুতি এরকম পরিণতিই বয়ে আনে।
বৈঠকের সপ্তাহখানেক পর এক বৈঠকে তাহের ইঙ্গিত করলেন, ব্যাপক গণ-সমাবেশ, যেটা তিনি আশা করেছিলেন, তাতে জাসদ সাংগঠনিকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। বিপুল সংখ্যক মানুষ রাস্তায় নেমে এসে সিপাহিদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিনন্দিত করলেও, অতীতে যেমন ছাত্র-জনতা-রাজনৈতিক কর্মীদের ব্যাপক আলোড়ন দেখা গেছে, এক্ষেত্রে তেমনটি ঘটেনি। ৪ ও ৫ নভেম্বর জাসাদের আন্ডারগ্রাউন্ড নেতৃত্বের এক বৈঠকে ঐসব শক্তিগুলোকে সক্রিয় করে তোলার দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। অবশ্য দায়িত্বপ্রাপ্তরা পরে যথেষ্ট আন্তরিকতা ও তৎপরতা নিয়ে মাঠে নামেনি। অভ্যুত্থানের বেশ কয়েকটি দিক ছিল। কেবল যে সামরিক শক্তিকেই সংগঠিত করা হয়েছিল তা নয়, ছাত্র-কর্মীদেরও বিষয়টি জানানো হয়েছিল এবং তাদের সংগঠিত ঐক্যের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছিল। লক্ষ্যনির্ভর বিদ্রোহের হাতকে মুষ্টিবদ্ধ করতে হলে সকল আঙ্গুলকে তো একসঙ্গেই গুটাতে হয়।
৬০-এর দশকের শেষ এবং সত্তরের দশকের শুরুর দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসসহ জেলার অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সুসংগঠিত বিক্ষোভ, সমাবেশে মুখর হয়ে ওঠে। যারা তখন এসব সমাবেশের আয়োজন করেছিল, এখন তারা জাসদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে। কিন্তু ৭ তারিখের সকালে তারা তাদের আগের সেই ক্ষমতা দেখাতে ব্যর্থ হন। ৭ নভেম্বরের ঠিক পরের দিন বেসামরিক কর্মীদের সক্রিয় হয়ে উঠতে দেখা যায়। তবে অচিরেই তাদের কৌশলগত উদ্যোগ শিথিল হয়ে পড়ে।
পূর্বধারণা অনুযায়ী কেন সংগঠিত সমর্থন পাওয়া যায়নি সে ব্যাপারেও যথেষ্ট বির্তক রয়েছে। শ্রমিক শ্রেণী, ছাত্র ও ব্যাপক মানুষের সক্রিয় ও সমন্বিত সমর্থন ছাড়াই সেনাবাহিনীর একটি অংশে বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল। ১৯৭৩ ও ৭৪ সালে যে সংগঠনটি লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়েছে, তাদের পক্ষে এ ধরনের রাজনৈতিক কর্মকা- সামর্থ্যরে বাইরে থাকার কথা ছিল না। ৭ নভেম্বরের সকালে জাসদ পরিষ্কারভাবে তাদের কোনো সুস্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করেনি, যা অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিকে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার এবং বিদ্রোহকে অন্যখাতে প্রবাহিত করার সুযোগ করে দেয়। জনগণের একটি বড়ো অংশ তখন পর্যন্ত ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি, অভ্যুত্থানের নায়ক আসলে কারা এবং তাদের নীতিই বা কী, যদি তা আদৌ থেকে থাকে। কয়েকটি স্লোগানই যথেষ্ট ছিল না। এতে কোনো সন্দেহ নেই, সমাজতান্ত্রিক ধারার কোনো সংগঠনের পক্ষে এগুলো খুবই মারাত্মক ব্যর্থতা।
বিষয়টি এরকমভাবে ভাবা সম্ভব যে, বিদ্রোহ-পরবর্তী দিনগুলোতে জাসদ যদি ব্যাপক জনসমর্থন প্রদর্শন এবং জনগণের আশা-আকাক্সক্ষাকে প্রতিফলিত করে এরকম রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করতে সক্ষম হতো, তাহলে জিয়াউর রহমান বা অন্য কোনো ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তার আর ভূমিকা পরিবর্তনের সুযোগ হতো না। কিন্তু কেন জাসদের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি, সেটা একটা মূল প্রশ্ন।
এর কোনো সহজ বা রেডিমেড উত্তর নেই। কেউ কেউ বলেন, যাদের উপর গুরুত্বপূর্ণ সব কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তারা তাদের কাজ ঠিকমতো করেনি। অন্যদের যুক্তি হলো: ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময়টা একটা বড়ো ধরণের প্রস্তুতির জন্য মোটেও যথেষ্ট ছিল না। তাদের মতে, যতো রকম চাপই থাক, জাসদের উচিত ছিল সংযম রক্ষা করে অপেক্ষা করা।
পাঁচ বছর পর যখন জাসদের বেশিরভাগ নেতা কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন, তখন দলের ঊর্ধ্বতন মহলে, এতদিনে যা ঘটে গেছে তা আর কাটিয়ে ওঠার ক্ষমতা ছিল না। কারাবাসের আতঙ্ক, ১৯৭৭ সালে গণহারে ফাঁসির ভয়াল স্মৃতি আর খুলনাসহ অন্যান্য জায়গায় কারাবিদ্রোহের সময় গণহত্যার অভিজ্ঞতার পর জাসদ নেতাদের পক্ষে সেসব দুঃস্বপ্ন কাটিয়ে ওঠা, নতুন করে জেগে ওঠা সম্ভব হয় না। বস্তুত পক্ষে, কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন যখন তার তাত্ত্বিক ধারণা এবং ব্যবহারিক কর্মকা-ের মূল্যায়নে অক্ষম হয়, তখন বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা তার পক্ষে ফের সংগঠিত হয়ে ওঠা আর সম্ভব হয় না।
তাই ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর জাসদ নেতারা যখন ফের একত্র হলেন; তখন অতীতের কর্মকা- পর্যালোচনা, পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ এবং পরিবর্তী রাজনৈতিক আবহে নতুন উদ্যমে নতুন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামার মতো সামর্থ্য সত্যিই তাদের ছিল না। সিরাজুল আলম খানের মতো শীর্ষ নেতারা অতীত কর্মকা-ের জবাবদিহি ও আত্মবিশ্লেষণ করার বদলে পদত্যাগ করে বসেন। অন্য নেতৃস্থানীয় যারা ছিলেন, তারা অধিকাংশই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগসাজশে অথবা নিজস্ব গ্রুপিংয়ের কারণে দলছুট হয়ে পড়েন।
আংশিকভাবে এটা বিভিন্ন নিরাপত্তা সংস্থার পরিকল্পিত কারসাজিরও ফল। এদেও কারসাজিটা ছিল অদুর্নীতিবাজদের সরিয়ে দেওয়া এবং দুর্নীতিপ্রবণদের উৎসাহিত করা। তাছাড়া দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতৃত্ব, যারা দলের সব থেকে সৎ ও নিবেদিতপ্রাণ সদস্য ছিল, কারামুক্তির পর তাদের পক্ষে পুরনো নেতৃত্বকে অবজ্ঞা করে আগের অবস্থানে ও নীতিতে ফিরে এসে দলকে পুনর্গঠিত কিংবা নতুন নেতৃত্বের ছায়াতলে দলকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা সম্ভব ছিল না। পরিণতিতে বাংলাদেশের বিপ্লবী রাজনীতির একটি সাহসী ও নাটকীয় অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বিপ্লবী লক্ষ্য অর্জনের মতো যথেষ্ট পরিণত একটি রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে জাসদ নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছিল কি পারেনি সে প্রশ্ন করা যেতেই পারে। এশিয়ার প্রায় সর্বত্রই দেখা গেছে বিশেষ করে কম্বোডিয়া ও আফগানিস্তানে, রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদেরকে সমাজবাদী ও বিপ্লবী আখ্যা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে এবং মুক্তিসংগ্রামের নামে জনগণের ওপর বর্বরোচিত ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে, যে জনগণকে তারা বন্ধন-মুক্তির স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে, কিন্তু শেষ হয় না সেই পরিস্থিতির যার মধ্য দিয়ে উদয় ঘটে আবু তাহেরদের মতো মানুষের, যা জন্ম দেয় তাদের মতো মানুষের আত্মপ্রত্যয় এবং কাজে নামার প্রেরণা। এ বিষয়গুলো ধ্রুব হয়ে থাকে চিরকাল।
কোন পর্যায়ে, কোন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ অভ্যুদয় ঘটেছে তা বুঝতে হলে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশের ওপর লেখা একটি নিবন্ধ কাজে দেবে। এ নিবন্ধে নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্টার বাংলাদেশের এক ১৫ বছর সমবয়সী মেয়ে শাফিয়া খাতুনের বর্ণনা দিয়েছেন, যে মেয়েটি দারিদ্রকবলিত গ্রামবাংলা থেকে রাজধানী ঢাকার একটি গার্মেন্টেস ফ্যাক্টরিতে সামান্য বেতনের একটি চাকরি জুটিয়ে নেয়। ‘টাইমস’ এটাকে ‘পথিকৃত যাত্রা’ নামে অভিহিত করে।
রিপোর্টে বলা হয়, শাফিয়া খাতুন যে কাজটি পেয়েছে, সে ধরনের নারীশ্রম কে বাংলাদেশে আশীর্বাদ হিসেবে গণ্য করা হয়। মেয়েটি মাসে ৩৭৭ টাকা করে রোজগার করে। শ্রমের ক্ষেত্রে এটা ‘ডিকেনসিয়ান পরিস্থিতির’ পর্যায়ে পড়ে। এই শ্রমশর্তটি সেই উনবিংশ শতাব্দীতেই ইউরোপ ও আমেরিকায় আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। কেবল শিশুদের ক্ষেত্রেই নয়, প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্যও আইনটি প্রযোজ্য। অবশ্য বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের ঔপনিবেশিক শাসন-পরবর্তী অনেক সমাজেই পশ্চিমা অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এ আইন কার্যকর করছে। শাফিয়া খাতুনের চাকরিদাতা সালেহা গার্মেন্টেসের মালিক রেদোয়ান আহমেদ বলেছেন, তাঁর শ্রমিকরা রুটি-রুজির জন্য মাসে ১৩ ডলার বেতনের কাজ করতে প্রস্তুত। এমনকি তারা কোনো আপত্তি ছাড়াই দীর্ঘসময় আরও কঠিন শর্তে কাজ করতে রাজি। একজন গবেষক তার রিপোর্টে বর্ণনা করেছেন কীভাবে ফ্যাক্টরি মালিকরা দরজা বন্ধ করে নারী শ্রমিকদের আটকে রেখে প্রাপ্য মজুরি না দিয়ে ওভারটাইম করতে বাধ্য করে। ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর মতে, এতো অল্প মজুরিনির্ভর রপ্তানি বাণিজ্য চলছে দেখেই বাংলাদেশের পরিকল্পনাকারীরা আজ মাঝে মধ্যে শিল্পায়নের কথা বলার সাহস দেখাতে পারে।
টাইমসের রিপোর্টার অবশ্য একথা মনে করতে পারবেন না যে, এমন অনেক লোক বাংলাদেশে রয়েছে, যাদের স্মরণে আছে স্বাধীনতার পর পরই অন্য একদল পরিকল্পক শিল্পায়নের কথা বলেছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে, এখনকার তুলনায় সম্পূর্ণ ভিন্ন সামাজিক কাঠামোয় দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার আগে বাংলাদেশে পুঁজি বিনিয়োগ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসে তখনই যখন বিশ্ববাজারে নেতৃত্ব দানকারী দেশগুলো কিছু সহজ শর্ত আরোপ করে। ‘টাইমস’ লিখেছে:
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য কোটা পদ্ধতি চালু করার পরই কেবল সেখানে গার্মেন্টস শিল্পের বিকাশ ঘটে। এটা সাম্প্রতিক ঘটনা। যুক্তরাষ্ট্র এখন বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের মোট উৎপাদনের ৮৫ শতাংশ নিচ্ছে। সে দেশে বাংলাদেশের গার্মেন্টস সামগ্রী রপ্তানির পরিমাণ ১৯৮৪ সালের সাড়ে ৪ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ১৯৮৮ সালে দাঁড়ায় ৩০ কোটি ডলার, এবং বাংলাদেশ সে বছর আমেরিকায় গার্মেন্টস সামগ্রী রপ্তানিতে ষষ্ঠ বৃহত্তম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়।
মিলানের গার্মেন্টস শিল্পপতি পাওলো তাচ্চিনার্দি বলেন, ‘কাজের জন্য বাংলাদেশ হচ্ছে সব থেকে সস্তা জায়গা।’ কর্মীদের, ব্যবস্থাপকদের, জাহাজ মালিকদের পাওনা মেটানোর পরও একটি শার্ট যখন ইতালি এসে পৌঁছে, তখন সেটার দাম স্থানীয় বাজারের দামের চেয়ে তিনগুণ কম থাকে। আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, যে পোশাকগুলো পরছেন, সেগুলো নারী ও শিশুদের তৈরি। কিন্তু, আমরা যদি সেখানে গিয়ে ওদের কাজ না দিই, তাহলে ওদের আর কিছুই করার থাকে না। ইতালির গার্মেন্টস শিল্পপতি-রপ্তানিকারকের এই তথ্যের জবাব অবশ্যই বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনীতির একজন ছাত্রকে দিতে হবে। সত্যিই কি তাচ্চিনার্দি যদি মিলান থেকে এসে শাফিয়া খাতুনের মতো শিশু শ্রমিকদের কাজ না দেন, তবে কি তাদের কিছুই থাকে না? এটাই কি বাংলাদেশের জন্য এখনো একমাত্র উপায়? প্রথমদিকে ইউরোপীয় বণিকরা দক্ষিণ এশিয়ায় এসে ঔপনিবেশিক আনুগত্যের বিনিময়ে উপহার দিয়েছিল ঈশ্বর ও সাম্রাজ্যবাদ। আজকের দিনে তারা দিচ্ছে ‘কাজ’, বিনিময়ে নিচ্ছে তিনগুণ মুনাফা। আসলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্তরসূরী এখনো সেখানে রয়ে গেছে।
একটি দেশ, যে একদা গর্বিত ছিল গোটা এশিয়ার বাজারে মসলিনের মতো মিহি কাপড়, সুতা আর সিল্ক সরবরাহের একচেটিয়া ব্যবসা নিয়ে, সে এখন শুধু সেলাই করছে নিউইয়র্ক, প্যারিস আর টোকিরও দোকানগুলোর জন্য সস্তা পোশাক। নিজের গরীব বস্ত্রহীন নাগরিকের জন্য যে জাতির আজ বস্ত্র উৎপাদনে দৃষ্টি দেওয়ার কথা, সে আজ তা না করে পোশাক তৈরি করছে ধনী দেশের জন্য।
এটা অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, দেশের স্বাধীনতার জন্য কর্নেল তাহেরের মতো আরও যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। বাংলাদেশের জনগণকে যেন আর কখনো নিজ দেশে ক্রীতদাসে পরিণত হতে না হয়, সেজন্য ঐ দৃষ্টিভঙ্গিটা ফিরিয়ে আনতে হবে।

bottom of page