
কর্নেল তাহের: ভূমিকা কথা
কর্নেল তাহের: ভূমিকা কথা
লরেন্স লিফশুলৎস
দু শ বছরের বেশি আগের কথা। প্রায় আটশো, ইউরোপীয় অনিয়মিত সৈন্য বাংলার নবাবের প্রায় পঞ্চাশ হাজার নিয়মিত সৈন্যের বিশাল বহিনীর মুখোমুখি হলো। সেদিন শুধু লোকবলে নয়, কামানের শক্তি ও কারিগরি নৈপুণ্যেও বাঙালিরা ছিল ইউরোপীয়দের ওপরে। তবুও এই যুদ্ধে ইউরোপীয়দের সহজ বিজয় হয়। পৃথিবীর ইতিহাস বদলে যায় এর ফলে। ‘ভাগ্য-নির্ধারণী লড়াই বলে যে সব যুদ্ধ চিহ্নিত হয়ে এসেছে তার মধ্যে এটাই ছিল সর্বকালের শোচনীয়তম খ-যুদ্ধ। তখন সতেরশো সাতান্ন সাল। দিনটা ছিল তেইশে জুন। এটাই বিখ্যাত পলাশীর যুদ্ধ।
জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সবার মধ্যেই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিংবদন্তীর জন্ম নেয়। তবে বাংলা বিজয় কোনো অতিপ্রাকৃত ব্যাপার নয়। আধুনিক পশ্চিমা গোয়েন্দা বিশেষজ্ঞদের ভাষায় আসলে এই যুদ্ধে লোকচক্ষুর অন্তরালের সাথে গোপন ষড়যন্ত্র চালানো হয়েছিল মাত্র। বাংলার নবাবের সেনারা কখনোই ইউরোপীয়দের কাছে সামরিক শক্তিতে পরাজিত হয়নি। আসল ব্যাপারটা আরো অনেক সাধারণ। উভয়পক্ষের সৈন্যদল পলাশীর আ¤্রকাননে পৌঁছাবার আগেই নবাবের বাহিনীর সেনাপতিকে ব্রিটিশেরা হাত করে নিয়েছিল।
ব্রিটিশেরা বাঙালি নেতৃত্ব ও শাসক শ্রেণীর মধ্যে বিদ্যমান বিভেদের গভীরতা বুঝতে পেরেছিল। চরম ধূর্ততার পরিচয় দিয়ে এরা দেশপ্রেমিকদের থেকে দুর্নীতিবাজদের আলাদা করে চিনতে সক্ষম হয়। আর এরা এসব ক্ষমতালোভী নীতিবিবর্জিত লোকজনদের সাফল্যের সাথে ব্যবহার করে চতুরভাবে বাজির চাল দিয়েছিল। রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ অভিযোদ্ধাবাহিনী পূর্বনির্ধারিত রাজনৈতিক চμান্ত অনুযায়ী সামরিক বিজয় অর্জন করলো। ‘পলাশীর ঘটনার পর ব্রিটিশরা ভারতীয়দের বিরুদ্ধে একটার পর একটা যুদ্ধে অবর্তীণ হয় ও ভারতে তাদের আসন পাকাপোক্ত করে নেয়। এরা নিজেদের স্বার্থে উপমহাদেশের সনাতন স্বনির্ভর গ্রাম ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে এক অভিজাত শ্রেণীর সৃষ্টি করে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার ভাগ্যের সাথে যাদের ভাগ্য ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’
উনিশ শতকে পৃথিবীব্যাপী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণের মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। বাংলাদেশে প্রাক-পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার পূর্ণ রূপান্তর ঘটানো হয়। নীল, পাট, চা, আফিমের চাষ, জমির ব্যক্তিগত মালিকানা স্বত্ত্ব, জমিদারি প্রথা ও ভূমি কর থেকে শুরু করে কৃষকের দেনা শোধ করতে তার জমি μোক করার অধিকার পর্যন্ত সব ধরনের আইন করা হয়। এভাবেই দক্ষিণ এশিয়ার এই ঘাঁটি থেকে কখনো যুদ্ধ জয়ী হয়ে, কখনো অবারিত দ্বারের ‘অধিকারের ছুতো দেখিয়ে ব্রিটিশেরা পুরো এশিয়া ইউরোপীয় ধাচের আধুনিক শিল্প ব্যবস্থা ও খোলা বাজার প্রবর্তন করে।
এই সব কিছুরই শুরু হয়েছিল পলাশীতে। এই বইয়ের (অসমাপ্ত বিপ্লব) মূল ঘটনার সূত্র ধরতে হলে স্মৃতির সভায় এই ঘটনাগুলো আবারো ফিরিয়ে আনাটাই হবে যুক্তিযুক্ত। বাঙালিরা এই মঞ্চের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত। তাদের কাছে এসব চেনা ঠেকতে পারে। তবে অন্যান্য পাঠকরা হয়তো বহু প্রাচীন এক অভ্যুত্থানের করুণ ইতিহাসের সাথে ততটা পরিচিত নন। তবে যারা গুয়েতেমালার আরবেঞ্জ, ইরানে মোসাদ্দেক, কঙ্গোতে লুমুম্বা, ক্যাম্বেডিয়ার সিহানুক কিংবা চিলিতে আলেন্দের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা বিশ্বস্তভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন আমার বক্তব্য বুঝতে তাদের অসুবিধা হবার কথা নয়। এক অর্থে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার কাহিনী ছিল ভবিষ্যত রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের ইতিহাসের জন্য পূর্ব অধ্যায়।
১৭৫৬ সালের এপ্রিলে মাতামহ আলীবর্দী খানের মৃত্যুর পর সিরাজউদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে আরোহন করেন। মৃত্যুর আগে বৃদ্ধ আলীবর্দী খান সিরাজকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বণিকদের μমবর্ধমান শক্তি ও স্বেচ্ছাচারিতার ব্যাপারে সাবধান করে দিয়েছিলেন। বৃদ্ধ তার পৌত্রকে সাবধান করেছিলেন, রাজ্যের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতা হুমকির সম্মুখীন। মৃত্যুর আগে তিনি সিরাজকে একটা ব্যবস্থা নিতে বলে যান কথিত রয়েছে-
দেশে ইউরোপীয়দের যে শক্তি রয়েছে তার কথা সব সময় মনে রাখবে। তেলিঙ্গা এলাকায় (দক্ষিণাত্য) তাদের সমর রাজনীতি সম্বন্ধে সজাগ থাকবে। রাজাদের মধ্যে পারস্পরিক যুদ্ধ বিগ্রহের অজুহাতে তারা মুঘল সম্রাটের সাম্রাজ্য দখল করে এই সাম্রাজ্যের জনসাধারণ ও তাদের সম্পদ বিভক্ত করে ফেলেছে। তিন জাতির বিরুদ্ধে (ইংরেজ, ফরাসি আর ওলন্দাজ) একই সাথে লড়তে যেয়ো না। ইংরেজদের শক্তি সাংঘাতিক…ওদের সবচেয়ে আগে শক্তিহীন করবে। তাদের হারাতে পারলে অন্যদের বিরুদ্ধে তোমাকে বেশি বেগ পেতে হবে না। দাদু মনে রেখো ওদের কোনো অবস্থাতেই দুর্গ বানাতে বা সৈন্য বাড়াতে দিও না। যদি দাও তাহলে বুঝবে এদের আর তোমার নেই।
ক্ষমতায় এসেই সিরাজ আইন করে বিদেশি আর্মেনিয়ানদের সাথে ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্য সুবিধা সমান করে দেন। বহুদিন ধরে বিনা শুল্কে বাণিজ্য করার যে অধিকার ব্রিটিশদের ছিল এই আইন জারির ফলে তার অবসান ঘটে। এর সাথে প্রায় দুশো বছর পর উনিশশো একান্নতে মোসাদ্দেক সরকার ইরানে যা করেন তার তুলনা করা চলে। এ্যাংলো-ইরানীয়ান তেল কোম্পানির অব্যাহত ব্রিটিশ মালিকানার বিরুদ্ধে ইরানে জাতীয়তাবাদী মনোভাব ও অসন্তোষ তখন তুঙ্গে। মোসাদ্দেক প্রধানমন্ত্রী হবার পরই তেলশিল্পের জাতীয়করণ করা হয়। এর ফলে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের ইরানীয় প্রতিনিধি তরুণ শাহের সাথে মোসাদ্দেক সরকার অঘোষিত যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। দুবছরের মধ্যেই সি.আই.এ’র মধ্যপ্রাচ্য ব্যুরো প্রধান কারমিট রুজভেল্টের মধ্যস্থতায় সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ ও বহিঃশক্তির এক আঁতাত উনিশশো তিপ্পান্ন সালের আগস্টে একটা সুসংগঠিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মোসাদ্দেক সরকারের পতন ঘটায়; বিংশ শতকের তৃতীয় পদের জন্য ইরানের তেল সম্পদ এভাবেই পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতি উন্মুক্ত হয়ে যায়। বাংলাদেশে সেদিন যা ঘটেছিল পরবর্তীকালে তা সংশোধিত সংস্করণে আরো অনেক জায়গায় ঘটেছে। এটাতো একটা বহু পুরানোর কথা। বহু পরিচিত ঘটনা। তবে যে পাঠক এই বইয়ের পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে বিবৃত ঘটনাবলীর সাথে জড়িত হবেন তিনি যে তখন ১৭৫৬-৫৭ তে কী ঘটেছিল তার খেই হারিয়ে না ফেলেন।
নবার ইংরেজদের বাণিজ্য শুল্ক দিতে আদেশ তো দেনই, উপরন্তু কোলকাতায় সদ্যনির্মিত দুর্গ ত্যাগ করতেও নির্দেশ দেন। ইংরেজ বাণিজ্য প্রধান ওয়াটসের সাথে যোগাযোগের পর ইংরেজ গভর্নর ড্রেকের কাছে এক চিঠি লিখে নবাব জানান যে বণিক শ্রেণী হিসেবে বাংলায় বাণিজ্য করার জন্য তিনি সব সময়ই ব্রিটিশদের স্বাগত জানাবেন কিন্তু তাই বলে দুর্গ বানানোর অধিকার তাদের একেবারেই নেই। বাংলার মাটিতে কোনো
বিদেশি সামরিক ঘাঁটি সহ্য করা হবে না, কাজেই যা বানানো হয়েছে তা সব ভেঙে ফেলতে হবে। ইংরেজ গভর্নর জবাব দিতে টালবাহানা করেন ও পরে যে চিঠি দেন তা ছিল স্বভাবসুলভ কুটনৈতিক দুর্বোধ্যতায় ভরা।
তাতে নবাবের আদেশ অনুযায়ী কোনো পদক্ষেপ নেয়া হবে কি না তার কোনো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল না। ড্রেকের ঔদ্ধত্যপূর্ণ জবাব পাবার পর রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে সিরাজ সতেরশো ছাপ্পান্ন সালের পহেলা জুন রওয়ানা দেন। পনের দিনের মধ্যে নবাব কোলকাতায় পৌঁছান। তিন দিন ধরে প্রতিরোধের হাস্যকর প্রচেষ্টার পর ড্রেক সদল-বলে জাহাজে করে পালিয়ে যান। জুনের বিশ তারিখে নবাবের বাহিনী ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ দখল করে।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের চাটুকারদের কাছে এই যুদ্ধের ইতিহাস মূর্ত হয়ে আছে কোলকাতার অন্ধকূপ ঘটনার মাধ্যমে। এতে একশোরও বেশি ইংরেজ বন্দী প্রাণ হারায় বলে অভিযোগ করা হয়ে থাকে। মনে হয় এই ঘটনার ওপর পুরো বিতর্কটাই চলে নবাবের অগোচরে। উপনিবেশবাদী প্রচারণা ও পক্ষপাতদৃষ্ট ইতিহাসের অনেকখানি দখল করে আছে এই কাহিনী। স্পিয়ার লেখেন ‘পঞ্চাশ বছর ধরে এই ঘটনার ওপরে তেমন কোনো দৃষ্টি পড়েনি। কিন্তু এরপর ঔপনিবেশবাদীদের কায়-কারবার প্রণেতারা নিজেদের জন্য একটা অনুকূল সূত্র পেয়ে গেলেন। ধীরে ধীরে এর গুরুত্ব এতটা বাড়ানো হয়েছিল যে ভারত সম্বন্ধে ‘প্রত্যেক ইংরেজ স্কুলছাত্রের’ দরকারি জ্ঞানের পরিধিতে পলাশীর যুদ্ধ আর সিপাহী বিপ্লবের সাথে ‘অন্ধকূপ হত্যাকা-’-ও জায়গা পেয়ে যায়।’ শেষে দেখা গেল এর পেছনের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটটাই অনেকে ভুলে গেছেন। অন্ধকূপের কাহিনী ইংরেজদের একটা আদি ‘রক্তবিসর্জন তত্ত্বে’ পরিণত হয়। দুইশো বছর পর ভিয়েতনামে তাদের যাবতীয় কর্মকা- সমর্থন করতে মার্কিনীরাও এই একই পথ ধরেছিল।
ব্রিটিশেরা এর পরে কোলকাতা থেকে তাদের ঘাঁটি ফলতাতে সরিয়ে নেয় এবং প্রতিআμমণের পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি নিতে থাকে। এই সময়েই আধুনিক গোয়েন্দা কার্যμমে ব্যবহৃত হয় এমন অনেক কালজয়ী পদ্ধতির ব্যবহার দেখা যায়। বাঙালি নেতৃত্বের মধ্যে বিদ্যমান রাজনৈতিক মতপার্থক্য ও শত্রুতার সুযোগ পুরোমাত্রায় নেয়া হয়। বাংলার সিংহাসনের আরো দুজন দাবিদার ছিলেন। ঢাকায় ঘসেটি বেগম আর পূণিয়ার শওকত জঙ্গ। দুজনই আলীবর্দী খাঁর বংশের লোক। জুনের যুদ্ধে পরাজয়ের আগেই ব্রিটিশেরা দুপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে ও নবাবের বিরুদ্ধে গৃহীত কোনো সম্ভাব্য পদক্ষেপকে সমর্থন দেয়ার ইঙ্গিত দেয়। শওকত জঙ্গের কাছে লেখা এক চিঠিতে ব্রিটিশেরা খোালাখুলি আশা প্রকাশ করে যে তিনি যেন ‘সিরাজউদ্দৌলকে পরাজিত করতে পারেন।’ কিন্তু নবাব খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি অসামরিক চাল খেলে ঘসেটি বেগমকে নিষ্কিয় করেন আর ফোর্ট উইলিয়াম যুদ্ধের পর শওকত জঙ্গের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাকে হত্যা করেন।
এর মধ্যে দক্ষিণ দিকে মাদ্রাজের ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত এলাকা থেকে নবাবের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সেনাবাহিনীর তরুণ অফিসার রবার্ট ক্লাইভকে এই অভিযানের নেতৃত্ব দেয়া হয়। রবার্ট ক্লাইভ পাঁচ বছর আগে মাদ্রাজে ফরাসিদের বিরুদ্ধে এক যুদ্ধে সবিশেষ কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। এই রবার্ট ক্লাইভই পরে হন বাংলার ইংরেজ গভর্নর। ডিসেম্বরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ফলতাতে পৌঁছায়। এরপর জুন পর্যন্ত দুদলের মধ্যে পর্যায়μমে কখনো যুদ্ধ, কখনো আলাপ-আলোচনা চলতে থাকে। শেষে ব্রিটিশেরা কলকাতা পুনঃদখল করে। নবাব তার পূর্ণ অস্ত্র বল প্রয়োগ করতে ব্যর্থ হন।
ডিসেম্বর আর জুনের মধ্যের সময়টাতে ক্লাইভ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী ইতিহাসে সম্ভব্য সর্বকালের গুরুত্বপূর্ণ গুপ্তচμান্তের আয়োজন করেন। ব্যাপারটা ছিল ব্রিটিশদের জন্য নিতান্তই সহজ। সিংহাসনের দাবিদার প্রয়াত শওকত জঙ্গের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে ইংরেজরা জানতে পেরেছিল শওকত জঙ্গ নবাব বাহিনীর অনেক উচ্চপদস্থ সেনানায়কদের সাথে গোপন যোগাযোগ রাখেন। তারা আরো জানতো ব্রিটিশের সাথে সহযোগিতার বিনিময়ে ক্ষমতা পাবার নিশ্চয়তা পেলে এরা নবাবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতেও প্রস্তুত। নবাব তখন ক্লাইভের বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, ক্লাইভ এ সময় নবাবের সেনাপতি মীরজাফরের সাথে গোপনে চুক্তি সারলেন। এতে মধ্যস্থতা করে জগৎশেঠ আর উমি চাঁদ দুজনেই প্রচুর টাকা আত্মস্থ করেন। পলাশীর যুদ্ধের এক পক্ষ আগে দশই জুন এই চুক্তি সম্পাদিত হয়। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক স্পিয়ারের মতে এক আনুষ্ঠানিক চুক্তিপত্রে ‘মীরজাফর কোম্পানির বিশেষ সুবিধা বজায় রাখার আশ্বাস দেন। তিনি কলকাতা পরাজয়ের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দশ লাখ পাউন্ড ও কলকাতার ইউরোপীয় বসিন্দাদের আরো পাঁচ লাখ পাউন্ড দিতে রাজি হন। এ ছাড়াও গোপন চুক্তিপত্রের মাধ্যমে কোম্পানি প্রধানদের বড়েসড়ো ক্ষতিপূরণ দেয়ার ব্যাপারেও ঐকমত্য হয়। প্রতিদানে ব্রিটিশেরা মীরজাফরকে বাংলার পরবর্তী নবাব পদে অধিষ্ঠিত করতে আশ্বাস দেয়। এভাবেই দুইপক্ষের সেনাদল পরস্পরের মুখোমুখি হবার দুই সপ্তাহ আগে পলাশীর যুদ্ধের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল।
বাইশে জুন ক্লাইভের সেনাদল পলাশীর প্রান্তে মীরজাফরের নেতৃত্বে জমায়েত নবাব বাহিনীর মুখোমুখি হয়। পরদিন সকালে মীরমদন ও মোহনলালের নেতৃত্বে ছোট দুটো দল পাঠানো হয় ক্লাইভের বাহিনীর মুখোমুখি হবার জন্য। হঠাৎ ছুটে আসা এক গুলিতে মীরমদন প্রাণ হারান। কিন্তু মোহনলালের বাহিনী সমানে এগিয়ে যায়। ক্লাইভের বাহিনীকে পিছু হঠাতে বাধ্য করে। এসময় কোনো কারণ না দেখিয়েই মোহনলালের সৈন্যবাহিনীকে পশ্চাদপসারণের আদেশ দেয়া হয়। মোহনলাল অবাক হয়ে গিয়েছিলেনÑএখন পিছু ফেরার সময় নয়, আমরা এতদূর এগিয়ে এসেছি যে যুদ্ধের ভাগ্য এখনই নির্ধারিত হবে। মোহনলালকে আবারো আদেশ করা হয়, শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে বাধ্য হয়ে তিনি তাঁর বাহিনী নিয়ে পিছু ফিরে আসেন। অন্যদিকে মীরজাফরের অধীন ইউনিটগুলো হঠাৎ করে পিছু হঠলে সামনের সারিতে প্রতিরক্ষা ব্যুহ সৃষ্টিকারী সেনাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। মীরজাফরের নেতৃত্বাধীন উচ্চপদস্থ সেনানায়করা শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কোনোরকম চেষ্টাও করেননি। ক্লাইভ ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায় বসে ছিলেন। স্পিয়ার লিখেছেন, ‘বসওয়াথে স্ট্যানলির মতো মীরজাফর তখন দূর থেকে তাকিয়ে, তার অপরিণামদর্শী বিশ্বসঘাতকতার ফসল হিসেব করতে ব্যস্ত’।
পাঁচ দিনের মধ্যেই আঠাশ তারিখে ক্লাইভের সৌজন্য মীরজাফর তার বহুআকাঙ্খিত বাংলার মসনদে আরোহণ করেন। সিরাজউদ্দৌলা ধরা পড়ার চার দির পর মীরজাফরের পুত্র মীরনের ইশারায় নিহত হন। উডরফ লিখেছেনÑ‘পতন হল সিরাজউদ্ধৌলা, উত্থান হল মীরজাফরের। এ সময় কোনো কিছুই হওয়া অসম্ভব ছিল না।’ দীর্ঘদিন ধরে বাংলা থেকে ব্রিটিশ বেনিয়াদের উচ্ছেদ করার জন্য ‘সামন্ত জাতীয়তাবাদী’ সিরাজের এক বছরের সংগ্রাম যখন মনে হচ্ছিল সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে, তখনই তা চিরদিনের জন্য হাতছাড়া হয়ে গেল। এর পরবর্তীকালের মর্মান্তিক অবমূল্যায়ন করেছেন স্পিয়ার এই বলে ‘শুরু হল নতুন যুগের।’ এই যুগ আধুনিক ইতিহাসের দীর্ঘতম উপনিবেশিক শাসনের যুগ।
তিন বছর পর প্রভূত গৌরবের সাথে কলকাতা ত্যাগ করার আগেই মীরজাফরের সাথে গোপন ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্লাইভ নগদ অর্থে দুই লাখ চৌত্রিশ হাজার পাউন্ড ছাড়াও চব্বিশ পরগনা জেলা জায়গীর হিসেবে পেয়েছিলেন, যার বাৎসরিক আয় ত্রিশ হাজার পাউন্ড। পুতুল নবাব হিসেবে মীরজাফর তিন বছর মুর্শিদাবাদে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সক্ষম হন। শেষে কোলকাতাবাসী ব্রিটিশদের বিরক্তিভাজন হয়ে উঠলে ক্লাইভের উত্তরসূরি ও বন্ধু হেনরী ভ্যন্সিটার্ট ১৭৬০ সালের অক্টোবরে মদ্যপ জনবিচ্ছিন্ন মীরজাফরকে ফুরিয়ে যাওয়া মদের বোতলের মতো ছুঁড়ে ফেলে দেন। মীরজাফরের জায়গায় তার জামাতা মীর কাশিমকে ক্ষমতায় বসানো হয়। তিন বছর পরে ব্রিটিশদের অবাধ লুটপাটে অতীষ্ঠ হয়ে মীর কাশেম প্রতিবাদী হয়ে উঠলে জাতীয়তাবাদী নবাবকে সরিয়ে ১৭৬৩ সালে পুরানো বিশ্বস্ত ভৃত্য মীরজাফরকে আবারো নবাব বানানো হয়। দুবছর পর পলাশীর ‘নায়ক’ মীরজাফর মারা যান।
প্রশ্ন উঠতে পারে এতদিন পর কেন আবার সেই নীতিভ্রষ্ট বিশ্বাসঘাতকদের পুরনো কথা টেনে আনা। কারণ শুধু এই নয় যে, বাঙালি জাতির মানসে এই কাহিনীর প্রভাব আজও অপরিসীম। আজও বাংলার ঘরে ঘরে সেনাপতি মীরজাফরের নাম বিশ্বাসঘাতকতার সাথে সমার্থক হয়ে রয়েছে। তবে এই কাহিনীর গুরুত্ব এইখানে যে আজকের বাংলাদেশে আবারও বিশ্বাসঘাতকতা আর বীরত্বের সেই একই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। আগের ঘটনাকে বলা যায় বর্তমান ঘটানার পুর্বসূরি। আধুনিককালের ঘটনার নায়ক ঢাকায় ক্ষমতাধিকারী জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাঁর বিরোধীরা তাঁকে ‘একালের মীরজাফর’ বলেন। শুধু স্থান-কাল-পাত্র মাত্র পৃথক, তা ছাড়া আগের ঘটনার সাথে এবারের ঘটনার কোনো তফাৎ নেই। হতে পারে জিয়ার বিরুদ্ধে অপবাদটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। তা হলেও তা সতর্ক তদন্তের দাবি রাখে। আর জিয়া যদি সত্যি সত্যিই আধুনিককালের মীরজাফর হয়ে থাকেন তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায় বাংলাদেশের ক্ষমতালোকে আরও অনেক মীরজাফর আজ ক্ষমতায় ধান্দায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
এই বইয়ের (অসমাপ্ত বিপ্লব) দুটো ভাগ রয়েছে। প্রথমভাগে বর্ণিত হয়েছে সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থান ও তৎপরবর্তী তাহেরের হত্যাকা-। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে পনেরই আগস্টের যে অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হন তার বিবরণ। এঁরা দুজনেই ছিলেন জাতীয়তাবাদী চিন্তাচেতনা সম্পন্ন। স্বাধীন বাংলাদেশ তার অস্তিত্বের জন্য এই উভয় ব্যক্তির কাছেই বিশেষভাবে ঋণী। তাহের ছিলেন একজন বিপ্লবজাতীয়তাবাদী ও মার্কসবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ আর মুজিব উন্নত পুঁজিবাদী দেশে প্রচলিত সোশ্যাল ডেমোμেসির একজন সমর্থক, মূলত একজন বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী।
তাহেরের জীবন ও তাঁর ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার কাহিনীর আগে বিবৃত হয়েছে। অবশ্য সময়ের ধারাবাহিকতায় মুজিব যে অভ্যুত্থানে মারা যান সেটাই আগে আসে। তাহের যে বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তা তার কয়েক মাস পরেই ঘটেছিল। এই অবিন্যাসের কারণ হচ্ছে বইয়ের দুই অংশের দুটো পৃথক পা-ুলিপির উৎস। যে গোপন বিচারে তাহেরের ফাঁসি হয় সেই গোপন বিচার চলাকালীন সময়ে ঢাকায় আমি একজন বৈদেশিক সংবাদদাতা হিসেবে অবস্থান করছিলাম। এই সময়ে প্রথমভাগের তথ্য সংগৃহীত হয়। তাহেরের মামলার ঘটনা সম্বন্ধে বিস্তারিত খোঁজ করতে গিয়েই আমি পনেরই আগস্টের অভ্যুত্থান সম্বন্ধে নতুন খবর পেয়ে যাই। দেশি-বিদেশি অনেককে খুঁটিয়ে খুটিয়ে প্রশ্ন করে করে আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারি গত চল্লিশ বছরে প্রথমবারের মতো ছিয়াত্তর এর জুলাইতে তাহেরের মৃত্যুদ-ের জন্য নেপথ্যে বাড়াবাড়ি করেছিলেন যে কজন গুটিকয়েক কর্মকর্তা তারা সবাই মুজিবের মৃত্যুর পরপরই উচ্চ ক্ষমতায় আসীন হন। এদের অনেকের জীবন বৃত্তান্ত পর্যবেক্ষণ করে এটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে এদের অনেকেই পাকিস্তান আমলে উচ্চপদস্থ নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা ছিলেন। অনেকে আবার একাত্তরে পাকিস্তানিদের পক্ষে দালালিও করেছিলেন। পরে যখন গবেষণায় হাত দিলাম, দেখি কখনো বিস্ময়, কখনো-বা কাকতালীয় যোগাযোগ বেড়েই চলেছে। এভাবেই দু-একটা ছোট-খাটো ঘটনার সূত্র ধরে আস্তে আস্তে বড় বড় সব যোগাযোগ বেরিয়ে আসতে থাকে। তখন ফার ইস্টার্ন ইকনমিক রিভিউ-এর দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা হিসেবে মুজিবের হত্যাকা-ের পর আমি যে রিপোর্ট করেছিলাম তা আমার কাছে সম্পূর্ণ বর্জনীয় মনে হয়। সহকর্মীদের সাথে মিলে আমি যে রিপোর্ট দাখিল করি তা ছিল প্রথম দৃষ্টির অভিমত। এ ক্ষেত্রে সাধারণত যা হয়ে থাকে এটা ছিল অনেক ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তিকর। একেবারে প্রকাশ্য ব্যাপারগুলোই আলোচিত হয়েছিল মাত্র। অবশ্যই অভ্যুত্থানের নায়করা চেষ্টায় ছিলেন তাদের দিক থেকে সবার দৃষ্টি সরিয়ে নেবার।
কিন্তু এটাও স্বীকার করতে হয় যে স্থানীয় ও বিদেশি সাংবাদিকরা ঘটনার গভীরে যেয়ে পুনঃনীরিক্ষণের মাধ্যমে এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য ও পরিণতি উদঘাটন করতে ব্যর্থ হন।
এর কারণ খুঁজুন। তাহলেই বুঝবেন আধুনিক সাংবাদিকতার ধারা, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বে পশ্চাত্য সাংবাদিকতার ধারাটা কী রকম। গত দশ বছর ধরে অকুস্থলীয় বিবরণ ও ত্বরিত সাংবাদিকতার ওপর জোর দেয়া হয়েছে। আগের সেই আবাসিক সাংবাদিকতার ধারা আর নেই। তখন সাংবাদিকরা সে দেশের ভাষা ও ইতিহাস শিখতেন, প্রতিদিনের রাজনৈতিক ঘটনাবলীর সূক্ষ্মতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করে সে দেশের অস্তিত্বের গভীরে ঢুকে যেতেন। এটা আস্তে আস্তে হারিয়ে যাচ্ছে। আজকের যুগের সঙ্গে যেন তা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। নিউ ইয়ার্ক টাইমস-এ আমার এক সহকর্মী বলেছিলেন কথাটা-‘আজকালকার দিনের উদ্দেশ্য হচ্ছে ৭৫০টা শব্দের মধ্যে এমন একটা প্রবন্ধ লেখা যাতে ছুটির পরদিন সকালে ষোল বছরের যে কেউ তা পড়ে সহজেই বুঝতে পারে।’ এর থেকে গভীর বিশ্লেষণে যাবার মানেই হচ্ছে বেশি বেশি করা। আজকের দিনে আমার এক প্রাক্তন রিভিউ সহকর্মী হার্ভে স্টকউইনের ভাষায় ‘বুদ্ধিদীপ্ত সাংবাদিকতা’র বড় অভাব। হয়তো ঘটনার গভীরে নিয়ে যেতে এই শব্দটা জুতসই নয়। তবু আমার মতে এটাই প্রয়োজনীয়। খুব কম সাংবাদিকই আছেন যারা একবার প্রথম পৃষ্ঠায় খবর ছাপাবার পর আবার তা নিয়ে মাথা ঘামান। তখন পরে দেখা যায় যে আসল ব্যাপারটা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম।
বাঙালি সাংবাদিক সমাজের ক্ষেত্রেও এই কথাগুলো পূর্ণভাবে প্রযোজ্য। সেন্সরশিপের ভার আর ভয় দেখানোর ধারাটা ঢাকায় কিছুদিন ধরে প্রবলভাবে বিরাজমান, একথা মনে রেখেও বলা যায় যে ভারতে ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা কিংবা পাকিস্তানে জিয়াউল হকের সামরিক আইনের সামনে সেদেশের সম্পাদকরা যেভাবে তাঁর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন সে তুলনায় বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিক মহল থেকে একেবারে নিষ্প্রভ প্রতিরোধ এসেছে। বিগত বছরগুলোর সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ খুব কমই প্রকাশিত হয়েছে।
তাহেরের মৃত্যুর এক বছর পর লন্ডনে তাহেরের কয়েকজন পুরনো সহকর্মী ও আত্মীয়স্বজন মিলে কনওয়ে হলে এক সভার আয়োজন করেন। সেখানে আমাকে কিছু বলতে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি যা বলেছিলাম তার কিছু অংশ আজও উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করিÑ
তাহের স্মৃতি সংসদ আমাকে যখন প্রথমে অনুরোধ করেন এই সভায় যোগদানের জন্য তখন কী করব তা নিয়ে আমি কিছুটা দ্বিধান্বিত ছিলাম। দক্ষিণ এশিয়ায় সংবাদদাতা হিসেবে আমার কাজ ছিল প্রতিদিনের ঘটনাবলী রেকর্ড করা। যে বৃহৎ সমস্যা নিয়ে উপমহাদেশে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভেদ ও রাজনৈতিক মতপার্থক্য সৃষ্টি হয়েছে তাতে বিভিন্ন পক্ষের আদর্শ বিতর্কের জন্ম দেয়াটা আমার কাজ নয়। আমি সমস্ত ব্যাপারটা সাংবাদিকের দৃষ্টিতে দেখতে চেষ্টা করেছি। আমি একটা ঘটনাকে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিশ্লেষণ ও লিপিবদ্ধ করে পাঠকের সামনে নিয়ে আসতে চেষ্টা করেছি।
সম্পাদকরা আজকাল বারবার তাদের সংবাদদাতাকে একটা গুণের কথাই মনে করিয়ে দেন, তা হচ্ছে ‘বস্তুনিষ্ঠতা’। এই পেশার মূল কথাই যেন বস্তুনিষ্ঠ হওয়া-এই শব্দটা নিয়ে আমাদের মধ্যে যথেষ্ট মাথা ঘামিয়েছেন। আমি এ ব্যাপারে একটা ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যা আমার মতে তাহেরের ঘটনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। সাংবাদিকরা অবশ্যই বস্তুনিষ্ঠ হবার ব্যাপারে আপস করতে পারেন না, তবে অনেক সময়েই নিরপেক্ষ থাকা যায় না। একটা উদাহরণ দেই, পঁচাত্তরে ভারতীয় সরকার স্থানীয় সংবাদপত্রগুলোর ওপর কড়া সেন্সরশিপ আরোপ করে, আর সেই ‘জরুরি অবস্থার’ সময় সেদেশে অবস্থানরত বিদেশি সংবাদদাতাদের ওপরও খবরদারির চেষ্টা করে। দিল্লিতে থাকাকালে সেই সময় আমি সেন্সরশিপের কাঠামো ও তা ভাঙার অভিযোগে আটক স্থানীয় সাংবাদিকদের অবস্থা বস্তুনিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করি। সোজাসুজিভাবে আমি নতুন নিয়ম কানুনগুলোর কথাই রিপোর্ট করি। তবে, অবশ্যই ব্যক্তিগতভাবে আমি সেন্সরশিপের ব্যাপারে নিরপেক্ষ ছিলাম না। আমি বস্তুনিষ্ঠভাবে রিপোর্ট করেছি। কীভাবে কোনো নিয়ম কখন কাজ করে। কারা এর খপ্পড়ে পড়লেন। কিন্তু সেন্সরশিপের ব্যাপারে আমার কোনো নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না। আমি এর সম্পূর্ণ বিরোধী ছিলাম-যেমন বিরোধী ছিলাম ইন্দিরার ‘গরীবী হঠাও’ আন্দোলনের নামে বস্তি ভেঙ্গে দেয়ার, ভিক্ষুকদের গ্রেফতার করার, সত্তর লক্ষ লোকের বাধ্যতামূলক বন্ধ্যাকরণের, পাইকারিহারে গ্রেফতারের আর এদের ওপর চাপিয়ে দেয়া নিষ্ঠুর শাস্তির।
অনেকেই দেখতে পান না কিন্তু আমি নিরপেক্ষ আর বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্টিং এর মধ্যে বিরাট ফারাক দেখতে পাই। একেবারে খাঁটি সংবাদ পরিবেশনের ব্যাপারে যেমন কোনো আপস করার উপায় নেই, তেমনি এটাও স্বীকার করতে হবে কিছু কিছু প্রশ্নে নিরপেক্ষতা বলে কোনো কিছুই নেই। এ জন্যেই আমি এই সভায় বক্তৃতা দেয়ার জন্য তাহের স্মৃতি সংসদের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছি।
গোপন বিচার ও গোপন মৃত্যুদ-ের ব্যাপারে আমি নিরপেক্ষ নই। তা জিয়াউর রহমান করুন কিংবা ফ্রাঙ্ক, স্ট্যালিন যে-ই করুন না কেন, আমি তার নিন্দা করবই। এটা একটা কাকতালীয় যোগাযোগই বটে, যে সময় আমি বাংলাদেশে পৌঁছাই তখন এই ধরনের একটা বিচার বিশ্বাসঘাতকতা, অবিচার আর মৃত্যুর পরিধিতে মর্মন্তিক এক বিয়োগান্ত নাটকের ব্যাপ্তি নিয়ে এক এক করে তার অধ্যায়গুলো মেলে ধরছিল।
আমি আর দুটো ব্যাপারে বলতে চাই। জাতীয়তাসূত্রে আমি একজন মার্কিনি। আমাদের দেশেও আশ্চর্যরকম অবিচারের বহুবিদিত অধ্যায় রয়েছে। সেখানেও ‘রাষ্ট্রের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছিল আইনের প্রμিয়া। আজও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রেজেনবার্গ, জো হিল, স্যাকো আর ভ্যানজেটির মতো আরও অনেকের হত্যাকা-ের স্মৃতি জাগরুক হয়ে আছে।
আজ আমার দুজনের নাম মনে পড়ছেÑব্যার্থোলোমেও স্যাকো আর গিউসেপ্পে ভ্যানজেটি। এই দুই দরিদ্র ইটালীয়ান নতুন আর সুন্দর জীবনের আশায় আমেরিকায় পাড়ি দিয়ে চμান্তের বেড়াজালে জড়িয়ে যান। তাদের হত্যা করা হয়, কেননা আমেরিকায়ও রয়েছে সালাউদ্দিন আহমেদ আর সফ্দারের মতো লোক। স্যাকো ও ভ্যানজেটির আমলে তাদের ডাকা হতো অ্যাটর্নি জেনারেল পামার ও জে. এডগার হুভার নামে।
আজ আমি এদের প্রসঙ্গ টানছি তার কারণ মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পর ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের গভর্নর মাইকেল ডুকাকিস ঘোষণা করেছেন অঙ্গরাজ্যের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে এই যে দুজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদ- দেয়া হয়েছিল। গভর্নর ঘোষণা করেছেন, প্রতি বছর এদের মৃত্যুদিবসে ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের অধিবাসীরা ‘স্যাকো এন্ড ভ্যানজেকিট মোমেরিয়াল ডে’ পালন করবেন। এই অঙ্গরাজ্যেই তাদের বৈদ্যুতিক শক দিয়ে মারা হয়েছিল। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসিকাষ্ঠে যা ঘটেছে তার সঠিক মূল্যায়ন করতে বাঙালি জাতি কি এত লম্বা একটা সময় নেবে? আমার তো মনে হয় না। শেষ করার আগে আরেকটি কথা বলতে চাই। উনিশশো একষট্টিতে লেখা পল বরনের একটা প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি। বরন একজন মার্কিন অর্থনীতিবিদ, যার লেখা ‘দ্য পলিটিক্যাল ইকনমি অব গ্রোথ’ বইটিকে তৃতীয় বিশ্বের অনগ্রসরতার ওপর প্রথম শ্রেণীর বিশ্লেষণীমূলক সমীক্ষা হিসেবে এখনো গণ্য করা হয়ে থাকে। আমি অবশ্য তাঁর কোনো অর্থনীতির প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিতে চাই না। আমার উদ্ধৃতি তাঁর লেখা ‘দ্য কমিটমেন্ট অব ইন্টেলেকচুয়াল’ প্রবন্ধ থেকে, আমার বিশ্বাস আজকের বাংলাদেশের ছাত্র, সাংবাদিক ও আইনজীবীরা এই উদ্ধৃতির সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পাবেন। ‘সি. পি. ¯েœা-এর লেখা পড়লে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে শুধুমাত্র সত্যের সন্ধানেই বুদ্ধিজীবীর অঙ্গীকার সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। একদিকে এই সীমানা যদিও বুদ্ধিজীবীর মূল অঙ্গীকারের ভিত্তিভূমি সৃষ্টি করে দিয়েছে, অন্যদিকে আসল সমস্যাটায় কিন্তু তা মোটেও হাত দেয়নি। সত্য কথা বলা হলো কি বলা হলো না তা নিয়ে আসল সমস্যা নয়, তার সঙ্গে অবস্থার পরিপেক্ষিতে সত্যের ধরনও আলোচিত হওয়া উচিত। কতটুকু বলা হলো আর কতটুকু চেপে যাওয়া হলো, তার খেয়াল রাখা দরকার। আজকের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কালে অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে μমাগত সেই ধরনের সত্যি কথাগুলো বলে যাওয়া হয়, যেগুলো ‘স্থিতাবস্থা’ রক্ষার জন্য আদর্শবাদী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। আর সেইখানে জোরও দেয়া হয় সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অন্যদিকে যেখানে সত্য প্রকাশ করাটা দরকার, সেখানে তা স্পষ্ট করে বললে, অখ- সত্যটা প্রকাশ করলে, তার খ- খ- অংশের পেছনে সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণ বের করে তাদের পারস্পরিক আন্তঃসম্পর্ক নির্ণয় করতে গেলেই গোলমাল বাঁধে। পেশাগত বৈষম্যমূলক আচরণ চালানো হয়। সোজ কথায় এঁরা সমাজচ্যুত হয়ে যান। অনেক সময় এতেও কাজ না হলে সোজাসুজি ভয় দেখানো হয়। কাজেই বুদ্ধিজীবী হবার জন্য মাত্র একটা শর্ত হচ্ছে সত্য প্রকাশ করার ইচ্ছা থাকা। সেই সাথে প্রয়োজন সাহসের। যা হয় হোক না কেন, যেকোনো সঙ্গতিপূর্ণ তদন্ত চালিয়ে যাবার দৃঢ়তা থাকা দরকার। ‘অস্তিত্বমান সব কিছুর তীক্ষ্ম সমালোচনায় হাত দিতে হবে। নিজ সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে নিরপেক্ষ সমালোচনা করার সাহস থাকতে হবে। ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংঘর্ষের ভয়ে যেন তা গুটিয়ে না যায়।’ কাজেই একজন বুদ্ধিজীবী হচ্ছেন মূলত একজন সামাজিক সমালোচক। যার দায়িত্ব হচ্ছে আরও উন্নত, আরও মানবিক ও যুক্তিযুক্ত সামাজিক ব্যবস্থা তৈরির পেছনে বাধাগুলো চিহ্নিত করা ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তা অতিμম করতে সাহায্য করা। অনিবার্যভাবেই স্থিতাবস্থা সংরক্ষণে ব্যস্ত শাসক শ্রেণী আর তাদের পোষ্য বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা তিনি ‘গোলযোগকালী’ ও ‘উৎপাত’ বলে চিহ্নিত হন। এই সব বুদ্ধিজীবীরা এঁদের কখনো ভদ্র ভাষায় কাল্পনিক বা আধিভৌতিক বলে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করেন। আর খেপে গেলে এদের অন্তর্ঘাতী ও রাষ্ট্রদ্রোহী বলে অভিযুক্ত করেন। এই অবস্থায় বুদ্ধিজীবীর জন্য তাঁর অঙ্গীকার ও কর্তব্য পূর্ণভাবে বিশ্বস্ত থাকাটা একান্ত জরুরি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। এই তো সুযোগ মূলত এ ধরনের একটা অবস্থায় একজন বুদ্ধিজীবীর ঘাড়ে দায়িত্ব বর্তায় মানবতা, যুক্তি ও প্রগতির ঐতিহ্যকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা। গোটা সভ্যতার ইতিহাসে এই তো আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান উত্তরাধিকার।
শেষ করছি বরনের অনুসরণে। বর্তমানে শুধু এতটুকুই আশা করা যায় যে একদিন বাংলাদেশও উপহার দেবে সেই ধরনের মানুষদের যারা তাঁদের উপযুক্ত দায়িত্ব পালন করবেন। এঁরা তাদের নীতি রক্ষার সংগ্রামে অটল রইবেন আর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের মানুষের কাছে তাহেরের জীবন ও ঐতিহ্যের বিশ্বস্ত ইতিহাস তুলে ধরতে পারবেন।
লরেন্স লিফশুলৎস
ক্যামব্রিজ
পহেলা মে, ১৯৭৯