
শাহাদুজ্জামান
কর্নেল তাহের: একজন ‘আউট অব দি বক্স থিংকার’
ইংরেজিতে একটি অভিব্যক্তি আছে ‘আউট অব দি বক্স থিংকার’ বলে। যারা প্রচলিত চিন্তা কাঠামোর বাইরে, মৌলিক এবং ব্যতিক্রমী চিন্তা-ভাবনা করেন, তাদেরই বলা হয় ‘আউট অব দি বক্স থিংকার’ বা ‘বৃত্তের বাইরের ভাবুক’। কর্নেল তাহেরের জীবন এবং কাজের উপর দীর্ঘদিন গবেষণা করতে গিয়ে তাঁকে আমার বারবার সেরকম একজন বৃত্তের বাইরের ভাবুক বা চিন্তক বলেই মনে হয়েছে। কর্নেল তাহেরের ব্যাপারে যারা আগ্রহী তারা সাতই নভেম্বরের পূর্বাপর সময়ে তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব, অন্যায় ফাঁসি, বীরদর্পে মৃত্যুবরণ ইত্যাদি বিষয়কে স্মরণ করেন। সেটি প্রয়োজনীয়। কিন্তু কর্নেল তাহেরকে কেবল বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি সন্ধিক্ষণের অমীমাংসিত চরিত্র হিসেবে স্মরণ না করে তাঁর কাজ এবং ভাবনার মৌলিকত্ব এবং আজকের প্রেক্ষাপটে তাঁর প্রাসঙ্গিকতা ইত্যাদি বিষয় ভেবে দেখাও অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি।
তাহের যখন রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন, তখন পৃথিবীর তথা বাংলাদেশের আর্থ, সামাজিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট ছিলো আজকের থেকে একেবারেই ভিন্ন। তাঁর কাজ, ভাবনার পক্ষে, বিপক্ষে বিতর্ক চলতেই পারে। কিন্তু তিনি সেসময়ের বাংলাদেশের সামাজিক, ভৌগলিক, রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে যে মৌলিক ভাবনা কাঠামোর ভেতর দিয়ে দেখেছিলেন সেটি লক্ষণীয়। কর্নেল তাহেরের কাজ এবং ভাবনার বিস্তারিত উপস্থাপন আছে আমার তিনশতাধিক পৃষ্ঠার ডকুফিকশন ক্রাচের কর্নেল বইটিতে। সেখানে আমি কর্নেল তাহেরকে কেন্দ্রীয় চরিত্রে রেখে পাক ভারত উপমহাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষিতে কর্নেল তাহেরের ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক জীবন, তাঁর রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতার ইতিবৃত্ত, মুক্তিযুদ্ধে তাঁর ভূমিকা, স্বাধীন বাংলাদেশে তাঁর রাজনৈতিক কর্মকা-, বাংলাদেশের ১৯৭৫ এর পট পরিবর্তন, পরবর্তীতে ৭ই নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লবের পূর্বাপর জটিল সময়ে তাঁর ভূমিকা, তাঁর ষড়যন্ত্রমূলক ফাঁসি ইত্যাদির যাবতীয় ইতিবৃত্ত উপস্থাপন করেছি।

আজকের এই সেমিনারে আমি সেই বিস্তারিত দৃশ্যপটে না গিয়ে খুব সংক্ষেপে কর্নেল তাহেরের ভাবনা এবং কর্মকা-ের বেশ কিছু প্রবণতা, যেখানে তাঁর সেই ‘আউট অব দি বক্স’ ভাবনার নিদর্শন পাওয়া যায় তারই নমুনা তুলে ধরবো। পশ্চিম পাকিস্থানের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্থানের আন্দোলনের ধারার মূল প্রবণতা দীর্ঘকাল ছিলো মূলত প্রতিবাদের, বিক্ষোভের এবং অসহযোগিতার। ক্রমশ তা স্বাধিকারের এবং অবশেষে স্বাধীনতার আন্দোলনে পর্যবসিত হয়। যদিও শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্থানকে স্বাধীনতার প্রশ্নে পশ্চিম পাকিস্থানের সাথে একটা সশস্ত্র সংগ্রামেই অবতীর্ণ হতে হয়েছিলো, কিন্তু সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি তেমন ছিলো না আন্দোলনকারীদের। আন্দোলনের একেবারে শেষ পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্থানের তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের ভেতর সশস্ত্র একটা ধারা চাঙ্গা হতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে তাহেরকে দেখি ব্যতিক্রমী অবস্থানে। তিনি সেই পঞ্চাশ দশকের শেষ থেকেই একটা সশস্ত্র ধারায় পূর্ব পাকিস্থানের স্বাধীনতা আন্দোলনের কথা ভেবেছিলেন। তিনি সে সময়েই মার্ক্সবাদে দীক্ষিত হয়েছিলেন এবং রাজনীতিতে ‘পলিটিকো মিলিটারী’ লীডারশিপের কথা সুনির্দিষ্টভাবে ভেবেছেন। তাঁর তৎকালীন সহপাঠী এবং তাঁর রাজনীতিতে সক্রিয় পরিবারের স্মৃতিচারণ থেকে সেই সাক্ষ্য মেলে।
ই ভাবনার ধারাবাহিকতাতেই তিনি পরবর্তীকালে তৎকালীন পাকিস্থান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন। তাহের তাঁর পরিবার এবং বন্ধুমহলে স্পষ্টতই ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি পাকিস্থান আর্মিতে যোগ দিতে যাচ্ছেন মেজর, ব্রিগেডিয়ার হবার স্বপ্নে নয় বরং মূলত সামরিক কৌশলগুলো শিখবার জন্য, যা তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্যবহার করবেন। তাই এ ঘোষণা যে নেহাত কল্পনাবিলাস নয় এবং তিনি যে মোটেও কোনো সামরিক ক্যারিয়ার গড়বার জন্য আর্মিতে যাননি তার সুস্পষ্ট প্রমাণ যখন দেখতে পাই, তিনি ষাট দশকের শেষে পাকিস্তান আর্মিতে থাকা অবস্থাতেই অত্যন্ত ঝুঁকি নিয়ে পূর্ব পাকিস্থানের তৎকালীন রাজনীতির সবচেয়ে রেডিক্যাল নেতা সিরাজ শিকদারের সঙ্গে মিলে গোপনে একটি সশস্ত্র বাহিনী তৈরি করেন। তাহের এবং সিরাজ শিকদার মিলে সেসময় সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রামের রূপরেখা তৈরি করেছিলেন এবং এ বিষয়ে বেশ কিছু বাস্তব পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। তাঁদের সেই উদ্যোগ নানা কারণে সফল হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক গতিপথ বিষয়ে তাঁর সেই আগাম পর্যবেক্ষণ, নিজেকে সশস্ত্র বিপ্লবী হিসেবে তৈরি করবার পদক্ষেপ হিসেবে সেনাবাহিনীতে যোগদান এ ব্যাপারগুলোর মৌলিকত্ব লক্ষণীয়।
তাহের ছিলেন স্বল্প কয়জন বাঙ্গালি আর্মি অফিসারদের মধ্যে একজন, যিনি পশ্চিম পাকিস্থানের বন্দী অবস্থা থেকে দুর্ধর্ষ অভিযানের মধ্য দিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে তিনি এগার নম্বর সেক্টরের দায়িত্ব নেন। শুরুতেই যুদ্ধ কৌশল প্রশ্নে যুদ্ধের সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে তাঁর একটা বিরোধ তৈরি হয়। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী তখন প্রচলিত যুদ্ধ পদ্ধতিতে নিয়মিত সেনা ব্রিগেড তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। কিন্তু তাহের তার বিরোধিতা করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধকে একটা গেরিলা যুদ্ধে রূপান্তরের পরামর্শ দেন এবং শুধুমাত্র কৃষক, শ্রমিকদের নিয়ে অধিক হারে প্লাটুন গঠনের পরামর্শ দেন। এনিয়ে কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য ঘটে। তাহের তাঁর পরিকল্পনা মতো নিজের সেক্টরে অল্প সময়ের ব্যবধানে কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সমন্বয়ে একটা বিশাল বাহিনী গড়ে তুলে অনেক বেশি আগ্রাসী গেরিলা পদ্ধতিতে যুদ্ধ চালান। উল্লেখ্য তিনিই একমাত্র সেক্টর কমান্ডার যিনি সম্মুখযুদ্ধে আহত হয়ে তাঁর পা হারিয়েছিলেন। বলাবাহুল্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জয় এসেছিলো গেরিলা কৌশলের মাধ্যমেই। সেই সঙ্গে তাহেরই একমাত্র সেক্টর কমান্ডার যিনি যুদ্ধক্ষেত্রে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক কর্মকা- চালু রেখেছিলেন। তাঁর প্রতিটি ছোট ছোট কোম্পানিগুলোতে তিনি একজন পলিটিকাল কমিশনার নিয়োগ দিয়েছিলেন, যার কাজ ছিলো যোদ্ধাদের নৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেয়া। তাহের যেহেতু সমাজতন্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধকে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন একটি জনযুদ্ধে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। অন্য আর কোনো সেক্টরে যুদ্ধের ময়দানে এমন নিয়মিত রাজনৈতিক চিন্তা চর্চার উদাহরণ পাওয়া যায় না।
স্বাধীনতার পর তাহের নতুন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর যে রূপরেখার প্রস্তাব করেছিলেন, সেটিও ছিলো অভিনব। তাহের স্পষ্ট লক্ষ্য করেছিলেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল চরিত্রটি গড়ে উঠেছিলো মূলত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের সেনাবাহিনীর আদলে, যার মূল কাজ ছিলো ভারতীয় নেটিভদের ঠেঙ্গানো। কিন্তু বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর জন্ম হয়েছে একটা জনযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। ফলে তাহের স্পষ্টতই বলেছিলেন, এদেশের সেনাবাহিনী পাকিস্থানি সেনাবাহিনীর মতো একটা জনবিচ্ছিন্ন, ঠেঙ্গারে বাহিনী হতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যে বাঙ্গালি সামরিক অফিসার আর সাধারণ মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে, যুদ্ধের পরও যেন সেই সেনা সদস্য এবং জনগণের ভেতরতার মিত্রতাটি অটুট থাকে। সেটি নিশ্চিত করতে তাহের ‘পিপলস আর্মি’র প্রস্তাব করেছিলেন। তিনি এমন একটি আর্মির কথা চিন্তা করেছিলেন, যারা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্যন্টনমেন্টে বসে শুধু পিটি প্যারেড করবে না, বরং তারা হবে জনগণের উন্নয়ন কাজের নিত্যকার সঙ্গী। তিনি আর্মিতে অফিসার এবং সেপাইদের ভেতর যে ব্যাপক বৈষম্য আছে, তাদের ভেতর প্রায় যে দাস-প্রভু সম্পর্ক আছে, সেটাকে ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। আর্মির ব্যাটম্যান প্রথা বাতিল করার প্রস্তাব করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রস্তাবিত নতুন ধারার এই সেনাবাহিনীর একটি মডেল তিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের অধিনায়ক থাকা অবস্থায় চর্চাও করেছেন। তৃতীয় বিশ্বের প্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী সম্পর্কে এধরনের ধারণা যুগান্তকারী। প্রশাসনের অসহযোগিতায় তিনি অবশ্য এই মডেল আর চর্চা করতে পারেননি এবং এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী থেকেই পদত্যাগ করেছেন। বলা বাহুল্য, সেনাবাহিনীর সাথে জনগণের দূরত্ব, সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীণ বৈষম্য ঘোচেনি এখনও। আমরা যদি নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করি, তাহলে দেখবো সাম্প্রতিক বিডিআর-এ যে হত্যাকা- ঘটেছে, তার পেছনেও রয়েছে সেনাবাহিনীর আভ্যন্তরীণ সেই বৈষম্য আর দূরত্বের বীজ, যা বহু আগেই সমূলে নিচিহ্ন করতে চেয়েছিলেন তাহের।
স্বাধীন বাংলাদেশের উন্নয়ন বিষয়েও তাহেরের ছিলো মৌলিক এবং স্বতন্ত্র কিছু ভাবনা। তাহের স্বাধীনতার পর পর ‘সোনার বাংলা গড়তে হলে’ নামে যে নিবন্ধটি লিখেছিলেন, সেখানে সরলভাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যত রূপটির ছবি এঁকেছিলেন। লক্ষ্য করবার বিষয়, তিনি নদীরে বাংলাদেশের প্রাণ বিবেচনা করেছিলেন এবং বাংলাদেশের যাবতীয় উন্নয়নের প্রস্তাব করেছিলেন নদীকে কেন্দ্রে রেখে। নদীতে বাঁধ দিয়ে তার দু’ধারে কল-কারখানা, স্কুল-কলেজসহ যাবতীয় কর্মকা-ের কথা বলেছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, মোগল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত বাংলাদেশে যে রাস্তাঘাট, রেললাইন নির্মাণ করা হয়েছে, তা নদীর স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করছে। নদীর সমান্তরালে না করে এসব রাস্তাঘাট, রেললাইন প্রায়শই করা হয়েছে নদীর আড়াআড়িভাবে। বাংলাদেশে অব্যাহত বন্যার এটাও একটা কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেছেন। তাহেরের লেখায় নদী বিষয়ক এই পর্যবেক্ষণ এবং উন্নয়ন ভাবনার মৌলিকত্ব দেখেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’ পত্রিকার তৎকালীন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ। পরবর্তীকালে লরেন্স তাহেরের বিপ্লবী ভাবনারও সহমর্মী হয়ে উঠেন এবং আজীবনের শুভাকাঙ্খীতে পরিণত হন। নদীর মতো এমন অসাধারণ সম্পদকে বাংলাদেশ সৃজনশীলভাবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ তো হয়েছেই, বরং উল্টো তাকে গ্রাস করেছে ধীরে ধীরে। তাহেরের সেই নদীভিত্তিক উন্নয়ন ভাবনাগুলো এখনও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
তাহের সমাজতন্ত্রিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ থাকলেও তিনি বারবার প্রচলিত ধারার বাম আন্দোলন অনুসরণ না করে মৌলিক এবং দেশজ একটি আন্দোলনের ধারা তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের বাম আন্দোলন বহুধাবিভক্ত। নিজে রাজনীতিতে সক্রিয় হবার প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে শুরু থেকেই একটি ঐক্যবদ্ধ বাম জোটের চেষ্টা করেছিলেন তাহের। তিনি একক উদ্যোগে সে সময়ের ছোট-বড় সব বাম রাজনৈতিক নেতাদের সাথে ব্যক্তিগতভাবে বৈঠক করেছিলেন। কিন্তু তাঁদের ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যর্থ হন তিনি। বামদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন আজও বাংলাদেশে একটি অসফল প্রচেষ্টা, যার উদ্যোগ বহু আগেই নিয়েছিলেন তাহের। তিনি সে সময় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতির বদলে দেশীয় ধারার রাজনীতির কথাও বলেছেন। তাহের যে জাসদে যোগ দিয়েছিলেন, তা মূলত এই দলটি প্রচলিত মস্কো এবং চীন এই দুই ধারার বাইরে দেশীয় ধারায় সমাজতন্ত্রিক আন্দোলনের কথা বলেছিলো বলেই। রাজনীতিতে যোগ দিয়ে তিনি বাম আন্দোলনে সম্পূর্ণ নতুন কিছু মাত্রাও যোগ করেন। প্রচলিত গ্রামভিত্তিক বিপ্লবী কর্মকা-ের সমান্তরালে তিনি শহরভিত্তিক অভ্যুত্থানের রূপরেখা তৈরি করেন। সেপাইরা যে এ দেশের বঞ্চিত জনগোষ্ঠীরই প্রতিনিধি এবং তাদের ভেতর যে বিপ্লবী সম্ভাবনা রয়েছে, সেটিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনায় এনে তিনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করেন। তাহেরের নেতৃত্বে যে সেপাই অভ্যুত্থান ঘটেছিলো, সেটি এই উপমহাদেশের ব্যতিক্রমী, মৌলিক একটি অভ্যুত্থান। ৭ই নভেম্বরের সেপাই অভ্যুত্থানের একটি সামরিক মাত্রা ছিলো এবং একটি বেসামরিক মাত্রা ছিলো। তাহেরের নেতৃত্বে সামরিক মাত্রাটি সফল হলেও জাসদের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ যারা এর বেসামরিক দিকটির দায়িত্বে ছিলেন, তাঁরা ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেপাইদের সেই অভ্যুত্থান সফল হয়নি ঠিক, কিন্তু এই অঞ্চলের বাম রাজনীতির ইতিহাসে সেটিই একমাত্র ঘটনা, যখন সমাজতান্ত্রিক আদর্শের একটি দল ক্ষমতার এতটা নিকটবর্তী হয়েছিলো এবং তাহের তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তাহের তেমন বিরল একজন রাজনীতিবিদ, যিনি তাঁর পুরো পরিবারকে তাঁর রাজনৈতিক এবং বৈপ্লবিক কর্মকা-ে সম্পৃক্ত করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বাধীন এগার নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন তাঁর আপন চার ভাই এবং কিশোরী বোন। কামালপুরের যে যুদ্ধে তিনি শেলের আঘাতে পা হারিয়েছিলেন, সেই অপারেশনে তাঁর সঙ্গে সরাসরি সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন তাঁর সেই চার ভাই এবং বোন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তিনি যখন জনগণকে সম্পৃক্ত করে পিপলস আর্মির মডেলটি চর্চা করছেন, তখন তাঁর সঙ্গী হয়ে সরাসরি নানা কর্মকা-ে যোগ দিয়েছেন তাঁর স্ত্রী। পরবর্তীকালে তিনি যখন জাসদে যুক্ত হন, তখন তাঁর সবকটি ভাই তাঁর সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন। সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থানে সরাসরিভাবে যুক্ত ছিলেন তাঁর চার ভাই। এই অভ্যুত্থান পরিকল্পনার মূল সব সভাগুলো হয়েছিলো তাহেরের বড় ভাইয়ের বাসায়। তাঁর অন্য ভাইরা সকলে ছিলেন অভ্যুত্থানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। পরবর্তীকালে তাহের গ্রেফতার হলে তাঁর মুক্তির লক্ষ্যে জাসদের যে সুইসাইড স্কোয়ার্ড ভারতীয় হাইকমিশনারকে অপহরণ করেছিলো, তার চার সদস্যের মধ্যে দুজনই ছিলেন তাঁর ভাই। সেই অপারেশনের সময় বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন তাঁর এক ভাই। এ অভ্যুত্থানের প্রেক্ষিতে যে ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তাহেরের ফাঁসি হয়, তার আসামী ছিলেন তাঁর অন্যান্য ভাইরাও এবং তাঁদের সকলের বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হয়। বিপ্লবকে এমন একটি পারিবারিক বিষয়ে পরিণত করার নজিরও বাংলাদেশে বিরল। লক্ষণীয়, তাহের যখন রাজনীতিতে প্রবলভাবে সক্রিয়, তিনি তখন একজন পঙ্গু মানুষ। নিজের শারীরিক সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে একজন পঙ্গু মানুষ দেশের একটি ঐতিহাসিক অভ্যুত্থানকে নেতৃত্ব দিচ্ছেনÑএমন উদাহরণ বিশ্ব ইতিহাসেও বিরল। আজকাল ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জড, ডিজেবল মানুষদের স্বার্থ, অধিকার নিয়ে বহুবিধ কর্মকা- আছে। তাদের ভেতর রোল মডেল তৈরি করবার চেষ্টা আছে। এ ব্যাপারে বিশ্ব প্রেক্ষাপটেও তাহের একজন ব্যতিক্রমী উদাহরণ। নিয়ম মাফিক পঙ্গু মানুষকে ফাঁসি থেকে অব্যাহতি দেয়ার কথা থাকলেও তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো এবং তাহের বীরদর্পেই ফাঁসির মঞ্চে উঠেছিলেন এবং সেখানে উঠে কবিতা পাঠ করেছিলেন। তাহের বলেছিলেন- ‘নিঃশঙ্ক চিত্তের চেয়ে বড় আর কোনো সম্পদ নাই’। তাহেরের এই ব্যক্তিগত সাহস, সততার ব্যাপারগুলো অনন্যসাধারণ, যা আমাদের রাজনীতি থেকে ক্রমশ বিলুপ্ত হতে চলেছে এখন।
আগেই উল্লেখ করেছি যে, কর্নেল তাহেরের কর্মকা- বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। সেপাই জনতার বিপ্লবের ব্যর্থতার গভীর পর্যালোচনা এবং সেখানে কর্নেল তাহেরের ভূমিকার বিশ্লেষণ এই ছোট নিবন্ধে সম্ভব নয়। আমি বরং এখানে মূলত বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, ভৌগলিক বিষয়ে তাহের যে নতুনভাবে, মৌলিকভাবে, সৃজনশীলভাবে চিন্তা করতে চেয়েছিলেন, সেই চিন্তা প্রক্রিয়াটির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। আমরা একটা ভিন্ন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এখন বসবাস করছি। বাংলাদেশ, তথা পৃথিবীর রাজনীতি একটা ঘোর পাকচক্রে পড়ে গেছে এখন। সমাজতান্ত্রিক শিবিরের পতনের পর ধারণা করা হয়েছিলো পুঁজিবাদী পথেই বুঝি পৃথিবীর মুক্তি আসবে। কিন্তু পুঁজিবাদও ব্যর্থ হয়েছে। এখন নানাভাবেই বিশ্ব সংকট মোকাবেলার কথা বলা হচ্ছে। অনেকে আবার সমাজতান্ত্রিক ভাবনার দিকে চোখ ফেরানোর কথা বলছেন। কিন্তু এটিও তারা অনুভব করছেন যে, পুরনো ধারার সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন এবং রাষ্ট্রচর্চায় ফিরে যাবার আর উপায় নেই। ভাবতে হবে নতুন করে। বিশ্ব অবস্থাকে বিবেচনায় রেখে প্রতিটি দেশকে খুঁজে পেতে হবে তার সংকট মোকাবেলার নিজস্ব পথ। অতীতের সব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সংকট মোকাবেলায় চাই ব্যতিক্রমধর্মী, মৌলিক, সৃজনশীল, ‘আউট অব দি বক্স’ ভাবনা, যেমন ভেবেছিলেন তাহের।
সূত্র: ৭ নভেম্বর ২০১২ তারিখে ‘৭ই নভেম্বর সিপাহী জনতার অভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে কর্নেল তাহের সংসদ যুক্তরাজ্য শাখা আয়োজিত লন্ডনের মন্টিফিয়ারি সেন্টারে অনুষ্ঠিত সেমিনারে মূল প্রবন্ধ হিসেবে পঠিত।