লুৎফার চিঠি
ফাঁসির মঞ্চে কর্নেল তাহের
লুৎফা তাহের
শ্রদ্ধেয় বড় ভাইজান,
আপনাকে যে কী লিখব তার কিছুই ঠিক করতে পারছি না। আমি ভাবতেও পারি না তাহের আর আমার সঙ্গে নেই। আমার জীবনসঙ্গীকে ছাড়া বাঁচার কথা আমি চিন্তাও করতে পারি না। মনে হচ্ছে বাচ্চারা খুব কষ্ট পাচ্ছে। এত ছোট বাচ্চা, কিছুই বুঝতে পারে না। নিতু বলে ‘বাবা, কেন তুমি মরলে, তুমি আমাদের সাথে থাকলে এখনো বেঁচে থাকতে।’ ওরা বুঝতেও পারে না ওরা কি হারাল। প্রতিদিন ওরা ফুল নিয়ে কবরে যায়। কবরের ওপর ফুল রেখে ওরা প্রার্থনা করে ‘আমি যেন বাবার মতো হতে পারি।’ যিশু বলে ওর বাবা চাঁদের দেশে ঘুমিয়ে আছে।
দুর্ভাগ্যবশত নিতু ওর বাবাকে সেই নভেম্বরে শেষ দেখে। কিশোরগঞ্জে থাকায় পরে দেখতে পায়নি। আমি খুবই ভাগ্যবতী। তাহের আমাকে যে পথ দেখিয়ে গেছে, তা-ই আমার আসল অস্ত্র। বেঁচে থাকতে সে আমাকে বাঙালি নারীর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম সম্মান দিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুতে আমি সারা পৃথিবীর শ্রদ্ধা অর্জন করতে পেরেছি। আমার সব আশাই এত কম সময়ে সে পূর্ণ করে গেল। তাহেরের বন্ধু ও সহকর্মীরা যখন আমাকে সহানুভূতি জানায়, মনে হয় তাহের এখনো এদের মধ্যে বেঁচে রয়েছে, চিরদিন বেঁচে থাকবে। এরা আমার আপনজনের মতো। আমি সত্যি গর্বিত, সে মৃত্যুকে পরাজিত করেছে। মৃত্যু তাঁকে কখনো মলিন করতে পারবে না। এখন যা ঘটেছে তার সবই আমি বর্ণনা করব।
১৭ জুলাই শনিবার ৩টার সময় তাহেরের মৃত্যুদ-ের রায় ঘোষণা করা হয়। আমাদের পক্ষের ২৫ জন ব্যারিস্টারসহ আমরা সবাই নির্বাক হয়ে গেলাম। সারাদেশের লোক ক্ষেপে গিয়েছিল, তার কারণ সরকার পক্ষ কিছুই প্রমাণ করতে পারেনি। এমনকি সরকারি সাক্ষীরাও ৭ নভেম্বরের অভ্যুত্থানে তাহেরের অবদানের কথা স্বীকার করেন। আতাউর রহমান, জুলমত আলীর মতো বিশিষ্ট ব্যারিস্টার, আলম আর অন্যরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়ে এই বেআইনি ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে চরম নিন্দা প্রকাশ করেন। তাহের তখন ব্যারিস্টারদের বলল, ‘এই সেই সরকার যাকে আমি ক্ষমতায় বসিয়েছি, এদের কাছে আপনারা কিছুই চাইবেন না।’ মৃত্যুদ-ের রায় শুনে তাহের অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল, অন্য বন্দীরাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাহের সবাইকে উদ্দেশ করে বলল, ‘জীবন যদি এভাবে বিসর্জন না দেওয়া যায়, সাধারণ মানুষের মুক্তি তাহলে আর কীভাবে আসবে?’ আমরা তাহেরকে বাঁচানোর সব রকম চেষ্টাই করেছিলাম। তাহের অবশ্য আমাকে লিখেছিল, ‘তোমার মাথা নত করো না, আমি মরণকে ভয় পাই না। তুমি যদি গর্ব অনুভব করতে পার, তাতেই যথেষ্ট।’
১৯ তারিখ বিকেলে তাহের আমাদের সবার সঙ্গে দেখা করে। সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ছিল। রায় দেওয়ার পর সে যা লিখেছিল আমার তা পড়ে শোনায়। পরে আমাকে বলে, ‘তোমার শোক করা সাজে না, ক্ষুদিরামের পর দক্ষিণ এশিয়ায় আমিই প্রথম ব্যক্তি যে এভাবে মরতে যাচ্ছে।’ আর সবাই আমাকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলেছে সেকথা তাহেরকে বললে সে বলল, ‘সে-কি জীবনের মায়া ফিরিয়ে আনার জন্য? আমার জীবনের দাম কি জিয়া অথবা সায়েমের জীবনের চেয়েও কম?’
সে আমাদের এত উদ্দীপনা দিয়েছিল যে আমরা সবাই হাসিমুখে বের হয়ে এসেছিলাম; তখনো কেউ জানতাম না যে এটাই আমাদের শেষ কথা। দেশের সব শিক্ষক, রাজনীতিবিদ এমনকি বিদেশিরা পর্যন্ত সরকারের কাছে অনুরোধ করে তাহেরের মৃত্যুদ- রদ করার জন্য, কিন্তু তাহেরকে বাঁচতে দেওয়ার মতো সাহস কর্তৃপক্ষের ছিল না। এরা তাই তাহেরকে সময়ের সীমানা ছাড়িয়ে অসীমের সন্ধান দিয়েছে, তাঁকে অমরত্বের সুধা দিয়েছে। ইউসুফ, বেলাল, মনু-তাহেরের সব ভাইয়েরাই তাঁর সঙ্গে ছিল। ২০ তারিখ সন্ধ্যায় তাহেরকে জানিয়ে দেওয়া হয় যে পরদিন ভোর ৪টায় তাঁর মৃত্যুদ- কার্যকর করা হবে। সে শান্তভাবে এ খবর গ্রহণ করে ও যাদের ওপর এ খবর দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল তাদের ধন্যবাদ জানায়। এরপর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থায় রাতের খাবার খেয়ে নেয়। পরে একজন মৌলবি এসে কৃত অপরাধের জন্য তাহেরকে ক্ষমা প্রার্থনা করতে অনুরোধ জানান। সে তখন বলে ওঠে, ‘আপনাদের সমাজের কালিমা আমাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। কখনো না। আমি সম্পূর্ণ শুদ্ধ। আপনি এখন যান, আমি এখন ঘুমাব।’ সে এরপর শান্তভাবে ঘুমাতে যায়। রাত ৩টার দিকে তাঁকে ডেকে ওঠানো হয়। কতক্ষণ সময় আছে জানার পর তাহের দাঁত মাজে, সেভ করে ও গোসল করে নেয়। উপস্থিত সবাই তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ‘আমার নিষ্পাপ শরীরে তোমাদের স্পর্শ লাগুক আমি তা চাই নাÑএই বলে তাহের তাদের নিবৃত্ত করে।
গোসল করার পর তাহের তাঁর জন্য চা করতে ও আমাদের দিয়ে আসা আম কেটে দিতে বলে। নিজে নিজেই সে নকল পা, জুতো আর প্যান্ট পরে নেয়। হাত ঘড়ি পরে, একটা ভালো শার্ট গায় দিয়ে তাহের তার চুলগুলো ভালোভাবে আঁচড়ে নেয়। এরপর সে আম আর চা খেয়ে নিয়ে সবার সাথে মিলে সিগারেট খেতে থাকে। একজন মৃত্যুদ-প্রাপ্ত লোকের এ রকম সাহস দেখে সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। তাহের তখন সবাইকে সান্ত¦না জানায়, ‘আপনারা হাসুন, সবাই এত বিষণœ কেন। আমি দুর্দশাগ্রস্তদের মুখ হাসিতে উদ্ভাসিত করতে চেয়েছিলাম। মৃত্যু আমাকে পরাজিত করতে পারে না।’ তাহেরকে জিজ্ঞাসা করা হয় তাঁর কোনো শেষ ইচ্ছা আছে কি না, তাহের জবাব দেয়, ‘আমার মৃত্যুর বিনিময়ে এ দেশের সাধারণ মানুষের শান্তি।’ এরপর তাহের জানতে চায়, ‘আর কোনো সময় বাকি আছে কি না?’ অল্প সময় বাকি আছে জানার পর তাহের সবার সামনে একটা কবিতা আবৃত্তি করতে চায়। তাহের এরপর তাঁর কর্তব্য ও অনুভূতি নিয়ে স্বরচিত একটা কবিতা আবৃত্তি করে। এরপর তাহের জানায়, ‘আমি এখন সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তোমরা এখন তোমাদের কর্তব্য পালন করতে পারো।’ তাহের ফাঁসিকাষ্ঠের দিকে এগিয়ে যায়। নিজেই ফাঁসির দড়ি তুলে নেয়। গলায় রশি পড়ে নেয়ার পর তাহের বলে ওঠে, ‘বিদায় দেশবাসী। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ। বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক।’ তাহের তখন তাদের বোতাম টিপতে বলে। কিন্তু কেউই সামনে এগিয়ে এল না। তাহের তখন এদের বিদ্রুপ করে বলে ওঠে, ‘তোমাদের কি এই সাহসটুকুও নেই?’ তখনই কেউ বোতাম টিপে দেয়, সব শেষ। তাঁর ভাইদের পরে মৃতদেহ দেখানো হয়। সেদিন জেলখানায় সাড়ে সাত হাজার বন্দীর কেউই দুপুরে ভাত খায়নি। আমাদের বেলা আড়াইটার সময় মৃতদেহ দেয়া হয়। কড়া নিরাপত্তার প্রহরার মধ্যে জেলের ভেতরে একটা গাড়ি নিয়ে গিয়ে তাতে মৃতদেহ তুলে দেওয়া হয়। এরপর হেলিপ্যাড পর্যন্ত পাঁচটা ট্রাক-বাস ভর্তি নিরাপত্তা প্রহরীদের পাহারার মধ্যে মৃতদেহ একটা হেলিকপ্টারে তুলে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় পারিবারিক গোরস্তানে তাহেরকে কবর দেওয়া হয়।
একটা বিশেষ ছাউনি তুলে সামরিক প্রহরীরা ২১ দিন পর্যন্ত তাঁর কবর পাহারা দিয়েছে, এরা এমনকি একজন মৃত লোককেও ভয় পায়। সে আমাদের মাঝ থেকে চলে গেলেও আমাদের জন্য রেখে গেছে এক মূল্যবান উত্তরাধিকার। মানুষের প্রতি তাঁর মহান কর্তব্য পালন করতে গিয়ে তাঁকে শেষে বিষ আর মধুÑএ দুটোর সামনে দাঁড়াতে হয়েছিল। নিজে বিষ গ্রহণ করে আমাদের জন্য সে রেখে গেছে মধুময় অমৃত। যেদিকে তাকাই চারদিকে শুধু অন্ধকার দেখি। কী করব তার কিছুই বুঝতে পারি না। মনে হয় সম্পূর্ণ হারিয়ে গেছি। তবুও আমি জানি আমার এই দুর্দশা চিরকাল থাকবে না। এর শেষ আসবেই আসবে। তাহেরের আদর্শ সবার আদর্শে পরিণত হয়েছে, তা দেখতে পেলেই আমি শান্তি পাব। শুধু দুঃখ এই যে সেই সুখের দিনে তাহের সেখানে থাকবে না।
Ñস্নেহের লুৎফা
কিশোরগঞ্জ
১৮ আগস্ট ১৯৭৬
টীকা: লুৎফা তাহের চিঠিটি লিখেছিলেন যুক্তরাজ্য প্রবাসী বড় ভাই ড. রফি আহমেদকে।
সূত্র: ‘সমগ্র জাতির মধ্যে আমি প্রকাশিত’; আবু তাহেরের ৭৩তম জন্মদিন ও সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের ৩৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে কর্নেল তাহের সংসদের স্মারক প্রকাশনা। (১৪ নভেম্বর, ২০১১)।