top of page

১১ নং সেক্টর

মুক্তিযুদ্ধ ও ১১নং সেক্টর

 

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই তাহের ও আরও কয়েকজন সহযোদ্ধা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতীয় সীমান্ত ঘাঁটি দেবীগড়ে পৌঁছান। ২৭ জুলাই দেবীগড় থেকে পৌঁছেন দিল্লি। আগস্টের প্রথম সপ্তাহে মুজিবনগর পৌঁছেন তাহের। দ্বিতীয় সপ্তাহে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী বিভিন্ন সেক্টরের যুদ্ধপরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও মতামতের দায়িত্ব দেন তাহেরকে। উদ্দেশ্য ছিল খুঁতগুলো চিহ্নিত করে আরও সুষ্ঠুভাবে যুদ্ধ পরিচালনার উপায় খুঁজে বের করা।

১২ আগষ্ট মেঘালয় সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে উপস্থিত হন তাহের। ১৫ অগাষ্ট কামালপুরের পাকিস্তানি ঘাঁটিতে প্রথম সুসংগঠিত আক্রমণ পরিচালনা করেন তিনি। এ এলাকাটি কোনো সেক্টরের অধীনে ছিল না। জিয়াউর রহমান ওই এলাকায় প্রচলিত সামরিক কায়দায় একটা ব্রিগেড গঠনের চেষ্টা করছিলেন। তখন ওই সেক্টরের নেতৃত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সন্ত সিং।

সামরিক গুরুত্ব উপলব্ধি করে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ককে ওই এলাকাকে সেক্টরে পরিণত করার প্রস্তাব রাখেন তাহের। বৃহত্তর রংপুরের (বর্তমানে কুড়িগ্রাম) রৌমারী, ভূরুঙ্গামারী, উলিপুর থেকে বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা হয়ে সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জেরও কিছুটা অঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় ১১নং সেক্টর। রণকৌশলগত দিক দিয়ে ঢাকা আক্রমণ করার জন্য এই সেক্টরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাই সেখানেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন তাহের। ওসমানী অসন্তুষ্ট মনে তাঁকে সেক্টর প্রধান নিয়োগ করেন। তাহেরের নির্দেশে কামালপুর শত্রুঘাঁটির আটশ গজ দূরে এগারো নং সেক্টরের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। কামালপুর ছিল ঢাকার প্রবেশদ্বার। তাহের জানতেন, এই পথেই আসবে চূড়ান্ত বিজয়।

অধিকাংশ সেক্টর কমান্ডার যুদ্ধ পরিচালনা করতেন প্রাতিষ্ঠানিক সেনাবাহিনীর ভাবদর্শে। তাহের বিশ্বাস করতেন জনযুদ্ধে, সে যুদ্ধে জনগণই প্রধান শক্তি। নিজস্ব ধ্যান-ধারণা নিয়ে ১১নং সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে নেমে পড়েন তাহের। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কোদালকাঠি দখল করেন তাহেরের যোদ্ধারা। এই সময়ে ১১নং সেক্টরকে দুটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। দায়িত্ব দেওয়া হয় স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ ও লে. মান্নানকে। মাঝামাঝি সময়ে মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর ব্রিগেড নিয়ে ১১নং সেক্টরের নিকটবর্তী তেলঢালা ত্যাগ করে সিলেট সীমান্তে চলে যান। ৭-১১ সেপ্টেম্বর ঐতিহাসিক ‘কামালপুর অভিযান’ পরিচালনা করেন তাহের। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে আরও পাঁচ জন সামরিক কর্মকর্তা ১১নং সেক্টরে যোগ দেন। বিভিন্ন সাব-সেক্টরে তাঁদের দায়িত্ব বণ্টন করা হয়।


৭-১২ অক্টোবর বিশাল ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে বিখ্যাত ‘চিলমারী রেইড’-এ প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দেন তাহের। অভূতপূর্ব সাফল নিয়ে ১৩ অক্টোবর রৌমারী প্রত্যাবর্তন করেন তিনি। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ১৭ হাজার গেরিলা বাহিনীর একাংশকে নিয়মিত বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে একটি ব্রিগেড গঠনের অনুমতি প্রার্থনা করেন তাহের। তবে কর্নেল ওসমানী ও মুজিবনগর সরকার তা প্রত্যাখ্যান করে।

সবার আগে ঢাকায় পৌঁছার স্বপ্ন দেখতেন তাহের। সেই লক্ষ্যে ঢাকার প্রবেশদ্বার কামালপুর দখলের যুদ্ধে শুরু হয় ১৪ নভেম্বর রাত একটায় জিরো আওয়ারে। সেদিন ছিল তাহেরের জন্মদিন। সম্মুখ সমরে কামালপুরের পতন প্রায় আসন্ন। হঠাৎ শত্রুর শেলে বাম পা হাঁটুর ওপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তাহেরের। চিকিৎসার জন্য তাঁকে ভারতে নিয়ে যাওয়ার সময় সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি বলেন, ‘আমি যাচ্ছি তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাও।’


১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৯৩ হাজার সদস্য যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারাই সর্বপ্রথম ঢাকা প্রবেশ করেন। তাহেরের অবর্তমানে মুক্তিবাহিনীর পক্ষ থেকে তাঁর বড় ভাই আবু ইউসুফ বীর বিক্রম ১৬ ডিসেম্বর সকালে যৌথ বাহিনীর সেনা অধিনায়কদের সাথে পাকিস্তান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল নিয়াজীর দপ্তরে আত্মসমর্পণ আলোচনায় যোগ দেন। বিজয়ের প্রতীক হিসেবে নিয়াজীর স্টাফ কারের পতাকাটি উঠিয়ে নেন তিনি। যে বিজয় এককভাবে বাঙালির হতে পারত, তাতে ভারতীয় বাহিনীর ভাগ বসানোয় তাহের কিছুটা বিষন্ন হন।​

bottom of page