top of page

এবোটাবাদ থেকে দেবীগড়

এবোটাবাদ থেকে দেবীগড়

আবু তাহের

২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সাল, কোয়েটা ইনফেন্ট্রি স্কুলে সিনিয়র টেকনিক্যাল কোর্স করছি। সারাক্ষণ অনেক ব্যস্ততায় কাটে। এই ব্যস্ততার মাঝেও মার্চ মাসে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলী নিয়ে আমাদের মধ্যে অনেক আলাপ আলোচনা হতো। আমরা সবাই ভাবতাম পাকিস্তানের রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি বিরাট পরিবর্তন আসবে। বেশীর ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টিকে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক দল বলে মনে করতো এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক ক্ষমতা তাদের পাওয়ার পক্ষপাতি ছিল। কিছুসংখ্যক অফিসার ভাবতো কোনো রাজনৈতিক দলকে ক্ষমতা দেয়া উচিত নয় এবং পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের একাত্মতা বজায় রাখার জন্য মার্শাল ল’ চালিয়ে যাওয়া উচিত। আবার অল্প সংখ্যক অফিসার মনে করতো পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার হাত থেকে বাঁচাবার জন্য আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দেয়া প্রয়োজন।

এসব আলাপ-আলোচনা নিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারদের মধ্যে প্রায়ই অনেক কথা কাটাকাটি ও মনোমালিন্যের সৃষ্টি হতো। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের মনে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষেতে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি হয় এবং আমরা সবাই ধরে নিয়েছিলাম যে যতই গ-গোল হোক না কেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবেই। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রার্থীদের সম্বন্ধে আমরা সবাই ও পশ্চিম পাকিস্তানের অনেকেই একটি উচ্চ ধারণা পোষণ করতো। সবাই ভাবতো, এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, অর্থনীতিবিদ ও প্রবীণ সামরিক কর্মচারীর সমন্বয়ে গঠিত। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল এই জনপ্রতিনিধিগণ পাকিস্তানে সুষ্ঠু গণতন্ত্র স্থাপনে সক্ষম হবেন এবং তার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির ক্ষেত্রে একটি বিরাট পরিবর্তন আসবে।

সামরিক বাহিনীতে বাঙালিদের সংখ্যা ছিল নগণ্য এবং এই ক্ষেত্রে আমরা একটি বড়রকমের রদবদল আশা করছিলাম। একটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে সশস্ত্র বিপ্লবের সম্ভাবনা আমরা কোনদিনই আশা করিনি। ২৫ শে মার্চ পর্যন্ত আমরা ভেবেছিলাম একটি আপোস মীমাংসা হবেই এবং শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধনামন্ত্রী নিযুক্ত হবেন। ২৬ তারিখ সন্ধ্যায় রেডিওতে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বক্তৃতা শোনার পর সর্বপ্রথম আমি জানতে পারি বাংলাদেশে কি বিভীষিকা নেমে এসেছে। অল ইন্ডিয়া রেডিও ও বিবিসি’র খবর শুনে বাংলাদেশের ঘটনাবলী আরো জানতে পারলাম। সারারাত কোয়েটার নির্জন রাস্তায় পায়চারী করে কাটলো। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে ব্যর্থ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যের আক্রমণকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার একটি উজ্জ্বল সম্ভাবনা আমি দেখতে পেলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালাবার সংকল্প নিলাম।

পরদিন বাঙালি অনেক অফিসারের সঙ্গে দেখা হলো। তারা কেবল নিঃসহায়ভাব দেখাতে লাগলো। আমরা যে এই গণযুদ্ধে অংশ নিতে পারি, তারা কেউ একথা চিন্তা করতেও সাহস পেল না। অপরপক্ষে বাঙালি সৈনিক যারা ছিল তারা একটা কিছু করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো এবং অফিসারদের কাছ থেকে নেতৃত্বের আশা করতে লাগলো। গুটিকয়েক তরুণ অফিসার ছাড়া বাকি সবাই ভীত ও ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলো এবং তারা এমন কোন কাজ করতে এবং ভাবতে চাইতো না, যাতে করে পাকিস্তানীরা তাদের ওপর কোনো সন্দেহ করতে পারে। যখন আমি বাঙালি অফিসারদের পালিয়ে বিপ্লবে অংশ নেওয়ার প্রস্তাব করলাম তখন তাদের মধ্যে কয়েকজন এমনও বলে বসলেন যেন আমি কোয়েটা থেকে না পালাই, তাহলে তারা বিপদে পড়তে পারেন। শিক্ষিত উচ্চপদস্থ বাঙালিরা, বাঙালি জনগণের আন্দোলনে যে কতটুকু বিস্ময়কর অপ্রয়োজনীয় অংশ তা আমি সেদিন বুঝতে পারি। তাই বারশত বাঙালি অফিসারের মধ্যে মাত্র ১৩ জন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। চেষ্টা ও দৃঢ় সংকল্প থাকলে এদের বেশীর ভাগই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারতো। অপরপক্ষে সৈনিকদের মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

৩০ মার্চ আমাদের কোর্স অসমাপ্ত অবস্থায় শেষ করে দেয়া হয়। এরমধ্যে কোয়েটা থেকে একটি ডিভিশন ও খারিয়া ক্যান্টনমেন্ট থেকে আরো একটি ডিভিশন হাওয়াই জাহাজে করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। বাংলাদেশে যে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে উঠেছে তা আমরা সবাই ভালোভাবে বুঝতে পারি। পয়লা এপ্রিল আমরা নিজ নিজ ইউনিটে ফিরে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছি, এমন সময় স্কুল কমান্ডেন্ট মেজর জেনারেল বি. এম. মোস্তফা আমাকে ডেকে পাঠান। আমার বিরুদ্ধে সরকারী নীতি ও সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করার অভিযোগ আনা হয় এবং আমাকে কোয়েটা ছেড়ে না যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সিনিয়র টেকনিক্যাল কোর্সের অফিসাররা কোয়েটার বিরাট চিলতান হোটেলে থাকতো। সবাই নিজ নিজ ইউনিটে চলে গেছেÑআমি একা সেখানে রয়ে গেলাম। সারাদিন বিভিন্ন দেশের রেডিও শুনি, আর অনিশ্চিয়তার মাঝে সময় কাটে। কেবলই ভাবি কোন পথে পালিয়ে যাওয়া যায়। সে সময় পর্যন্ত আমার মনে সংশয় ছিল ভারতবর্ষ আমাদের এই সশস্ত্র বিপ্লবে কতটুকু সাহায্য করবে। আফগানিস্তান সম্বন্ধেও আমি নিশ্চিন্ত হতে পারছিলাম না যে আফগান সরকার আমাকে বাংলাদেশে যেতে কতটুকু সাহায্য করবে।

পয়লা এপ্রিল থেকে সামরিক ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের বেশ কয়েকজন লোক আমার পেছনে লেগে থাকতো। তাদেরকে এড়িয়ে আফগানিস্তানে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা অনেক বিপজ্জনক ছিলো। ৭ই এপ্রিল আমাকে খারিয়া কেন্টে পাঠানো হয়। দু’জন অফিসার আমাকে লাহোরের পথে কোয়েটা এয়ারপোর্টে হাওয়াই জাহাজে তুলে দিয়ে এলো।

কোয়েটা এয়ারপোর্টে প্রত্যেক যাত্রীকে বেশ করে তল্লাশি করা হলো। হাওয়াই জাহাজকে ছিনতাই হতে বাঁচাবার ব্যবস্থা। হাওয়াই জাহাজে মাত্র আমরা কয়েকজন যাত্রী। আমি একা বসে আছি। একজন বাঙালি স্টুয়ার্ড এসে আমার পাশে বসলেন। দেশের অনেক কথা হলো এবং হাওয়াই জাহাজটি ছিনতাই করার সম্ভাবনা নিয়েও আলাপ হলো। ভদ্রলোক আমাকে বললেন, তাঁর কাছে কোন অস্ত্র নেই, কাজেই কিছু করা যাচ্ছে না। তাঁকে আমি বল্লাম, কিচেন থেকে দুটো ছুরি নিয়ে আসতে এবং সেগুলো দিয়ে আমরা ককপিঠে ঢুকে পাইলটকে জাহাজটি ভারতে নিয়ে যেতে বাধ্য করতে পারবো। ভদ্রলোক আমার কথায় রাজি হলেন, কিন্তু এরপর আর আমার কাছে ফিরে এলেন না।

খারিয়া পৌঁছলাম। এর মধ্যে আমার ইউনিট দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটেলিয়ন আটক ফোর্ট থেকে বাংলাদেশে চলে গেছে। খারিয়াতে আমাকে একটি আর্টিলারি রেজিমেন্টের সঙ্গে সাময়িকভাবে রাখা হলো। সেখান থেকে বেশ কিছুসংখ্যক বাঙালি অফিসার নিয়ে পালাবার পরিকল্পনা নিলাম, কিন্তু এখানেও আমাকে নিরাশ হতে হলো। বাঙালি অফিসাররা ড্রয়িং রুমে বসে অনেক কথাই বলতো এবং দেশপ্রেম দেখাতো, কিন্তু যখনই কিছু করার প্রশ্ন উঠতো, তাদের উৎসাহ ও সাহস শেষ হয়ে যেতো। এর মধ্যে একদিন ই. পি. আর. এ কার্যরত ক্যাপ্টেন দেলোয়ার খারিয়াতে এসে হাজির হলো। ২৫ শে মার্চ রাতে ঢাকায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয় এবং আমি যে আর্টিলারি রেজিমেন্টে ছিলাম সেখানে পাঠানো হয়। দেলোয়ারের কাছ থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতির কথা আরো জানতে পারলাম। দেলোয়ার আমার সঙ্গে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে রাজি হলো। অনেক করে বুঝিয়ে আমরা ক্যাপ্টেন পাটোয়রীকে আমাদের সঙ্গে আসতে রাজি করালাম। কোন রাস্তায় পালানো যায়, সেই চিন্তায়ই আমরা ৩ জন সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতাম।

দেলোয়ার ও পাটোয়ারী অবিবাহিত, কাজেই সে ব্যাপারে তাঁদের কোন ভাবনা ছিল না। আমার স্ত্রী সে সময় ময়মনসিংহ ছিলেন এবং আমরা জানতাম আমি পালিয়ে এলেই পাকিস্তানীরা তাকে ধরে নিয়ে যাবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অফিসারদের পালানোর প্রধান বাধা ছিল দু’টি। আমরা জানতাম ধরা পড়লেই বিচারের অপেক্ষায় না রেখে আমাদের হত্যা করা হবে এবং দ্বিতীয়ত: পালিয়ে এলে বাংলাদেশে আমাদের আত্মীয়-স্বজনের ওপর নেমে আসবে সামরিক বাহিনীর বর্বর নির্যাতন। পালাবার চেষ্টা নেবার আগে মনের দিক থেকে এই দুই বাধাকে অস্বীকার করার মনোবলের প্রয়োজন ছিল।

সে সময় খারিয়াতে আমাদের কাজ ছিল বিভিন্ন দেশের রেডিও শোনা আর বসে বসে নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করা। সাধারণত পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারেরা আমাদের সাথে রাজনৈতিক আলাপ আলোচনা করতো না। অল্প কিছুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী সিনিয়র অফিসার বাংলাদেশের ঘটনাবলীর জন্য অত্যন্ত লজ্জাবোধ করতেন ও আমাদেরকে কিছু দিন ধৈর্য ধারণ করে থাকার উপদেশ দিতেন। পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক জনগণ কোন সময়ই বাঙালিদের ওপর কোন বিরূপ মনোভাব প্রদর্শন করেনি। সকলের ধারণা ছিল সহসাই একটা আপোষ-মীমাংসা হবে। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে আমাকে এবোটাবাদ বেলুচ রেজিমেন্টাল সেন্টারে বদলি করা হয়। আমি ঠিক করে নিলাম, খারিয়া থেকে এবোটাবাদ যাওয়ার পথেই পালাতে হবে। ক্যাপ্টেন দেলোয়ার ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী রাওয়ালপিন্ডি বেড়াতে যাওয়ার বাহানা করে কয়েকদিনের ছুটি নিল। আমরা ঠিক করলাম, আজাদ কাশ্মীর হয়ে সীমান্ত অতিক্রম করে আমরা ভারতে পৌঁছবো। এর মধ্যে আমার বড় ভাই আরিফুর রহমান, যিনি প্লানিং ডিভিশনে ছিলেন, এবং ইসলামাবাদে থাকতেন, সীমান্ত এলাকার পাঠানদের কাছ থেকে ৩টি রিভলবার কিনে আমাদের দেন।

২৯ শে এপ্রিল বিকাল, আমরা ৩ জন সঙ্গে বেশ কিছু খাবার ও পানি নিয়ে বাসে চড়ে মঙ্গলা বাঁধের পাশে আজাদ কাশ্মীরের ছোট্ট শহর মীরপুরে এসে পৌঁছি। সেখানে একজন বাঙালি ইঞ্জিনিয়ার থাকতেন। আমরা ঠিক করেছিলাম, বিকালটা তাঁর বাড়িতে কাটিয়ে সন্ধ্যার পর শহর ছেড়ে পাহাড়ের পথ ধরে সীমান্ত অতিক্রম করবো। মীরপুর থেকে সীমান্ত প্রায় ৩০ মাইল দূরে। বাঙালি ভদ্রলোকের বাড়ি পৌঁছে দেখি দরজা জানালা বন্ধ। তিনি সপরিবারে রাওয়ালপিন্ডি বেড়াতে চলে গেছেন, যদিও তার সঙ্গে আমাদের আগেই কথা হয়েছিল। উপায়ান্তর না দেখে বিকালটা তাঁর বারান্দায় বসেই কাটালাম। সন্ধ্যার পর তার বাড়ি থেকে বের হয়ে শহর ছাড়বো, কিন্তু কেউ এগিয়ে যেতে সাহস করছে না। একটি অপরিচিত শহর ছেড়ে বস্তি এলাকার মাঝখান দিয়ে কারও সন্দেহের কারণ না হয়ে চলে যাওয়া যে কত বিপজ্জনক, সেদিন তা আমরা বুঝতে পারি।

রাত ৮টায় আমরা পায়ে হেঁটে শহর ছেড়ে এক পাহাড়ে আশ্রয় নিলাম। সেখান থেকে দিক নির্ণয় করে আমরা চলতে শুরু করলাম। ঘণ্টা দুই চলার পর আমরা বেশ হাঁপিয়ে উঠলাম। পাথরের উপর দিয়ে উঁচু নীচু পথ চলা অত্যন্ত কষ্টকর এবং আমরা ভেবে দেখলাম এভাবে চলতে গেলে নিরাপদ স্থানে রাতারাতি পৌঁছানো সম্ভব হবে না। নির্জন অন্ধকার রাত। কোন জনপ্রাণীর সাড়াশব্দও নেই। আমরা ঠিক করলাম পাহাড় ছেড়ে রাস্তা ধরেই এগিয়ে যাব। রাস্তা ধরে চলতে শুরু করার একটু পরেই রাস্তার পাশে একটি সাইন বোর্ড দেখতে পেলাম। পাটোয়ারী ও দেলোয়ারকে রাস্তার ঝোপের পাশে বসিয়ে রেখে আমি সাইন বোর্ডটি পড়ে দেখার জন্য এগিয়ে গেলাম। এ বোর্ডটি ছিল রাস্তার পার্শ্বে অবস্থিত একটি সাপ্লাই ইউনিটের দিক নির্দেশক। ক্যাপ্টেন দেলোয়ার এর মধ্যেই আমার পিছু পিছু এসে বোর্ডটি দেখলো এবং পিছনের দিকে চলতে শুরু করলো। এই সাপ্লাই ইউনিটটি সীমান্তে অবস্থিত ঘাঁটিগুলোতে খাদ্য ও সরঞ্জাম সরবরাহের কাজে নিযুক্ত ছিল। পেছনে ফিরে এসে দেলোয়ার ও পাটোয়ারীকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বললাম এবং তাঁদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তারা এপথে এগুতে রাজি হলো না। পাহাড়ের পর পাহাড় অতিক্রম করে যাওয়াও তারা বিপজ্জনক বলে মনে করলো। বাধ্য হয়েই আমাদের আবার মীরপুর শহরে ফিরে আসতে হলো।

ভাগ্যক্রমে একটি বাস পেয়ে গেলাম এবং তাতে চড়ে লাহোর-পিন্ডি গ্রান্ড ট্র্যাংক রোডে পৌঁছলাম। সেখান থেকে আমি এবোটাবাদের পথে ইসলামাবাদ চলে এলাম। ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী ও দেলোয়ার খারিয়া ক্যান্টনমেন্ট চলে গেল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালাবার প্রথম চেষ্টা আমাদের ব্যর্থ হলো। যদি সেদিন সাহস করে আমরা এগিয়ে যেতে পারতাম তবে সীমান্ত অতিক্রম নিশ্চয়ই সম্ভব হতো।

এবোটাবাদ পৌঁছে ব্যর্থতায় সারা মন ভরে উঠলো। এবোটাবাদের পাশেই পাহাড়ের গায়ে কাবুল সামরিক একাডেমী। একশত জনের উপর বাঙালি ক্যাডেট তখন সেখানে ছিল ও বেশ কিছু সংখ্যক বাঙালি অফিসার একাডেমীতে ইনসট্রাকটর হিসেবে কাজ করছিলো। সে সময়টাতে ৫ জন বাঙালি ক্যাডেট একাডেমী থেকে পালিয়ে যায় এবং এই নিয়ে বেশ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এবোটাবাদেও বেশ কিছুসংখ্যক বাঙালি অফিসার ছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা সকলেই উপলব্ধি করতো, কিন্তু যখনই পালিয়ে যাওয়ার কথা উঠতো তখনই তারা নানা অজুহাত দেখিয়ে সরে পড়তো।

ইতিমধ্যে দেলোয়ার ও ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী আবার আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং পালিয়ে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করে। সে সময় আমাদের গতিবিধির ওপর এত কড়া নজর রাখা হতো না এবং আমরা ছুটি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে আসার অনুমতি আমাদের দেয়া হতো না। প্রতি রোববারে আমি এবোটাবাদ থেকে পিন্ডি যেতাম। খারিয়া থেকে ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী ও দেলোয়ারও প্রায়ই সেখানে আসতো। সেখানে ক্যাপ্টেন দেলোয়ারের ভাই সাত্তার সাহেবের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। সাত্তার সাহেব প্লানিং ডিভিশনের উচ্চপদস্থ কর্মচারী ছিলেন। তিনি আমাদের সঙ্গে পালিয়ে আসতে আগ্রহান্বিত হয়ে উঠেন এবং সে জন্যে তার স্ত্রীকে লন্ডনে পাঠিয়ে দেন। তার স্ত্রী বিদেশিনী হওয়াতে তাকে পাঠানো সম্ভবপর হয়।
মেজর জিয়াউদ্দিন (পরবর্তীতে লে. কর্নেল এবং সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্তকৃত) সে সময় রাওয়ালপিন্ডি জেনারেল হেডকোয়ার্টারে চাকুরী করতো। একদিন কথায় কথায় সে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং আমরা তাকে আমাদের দলে টেনে নেই। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও আমরা আর কোন অফিসারকে আমাদের সঙ্গে পালাতে রাজি করাতে পারলাম না।

এবার আমরা ঠিক করলাম শিয়ালকোটের পথে সীমান্ত অতিক্রম করবো। মেজর জিয়াউদ্দিন জেনারেল হেডকোয়ার্টার থেকে একটি ম্যাপ যোগাড় করলো। সীমান্তের রাস্তা দিয়ে আমরা ৫ জন বাঙালি যদি বাসে চড়ে যাই, তাতে সন্দেহের উদ্রেক হতে পারে ভেবে আমরা সবাই মিলে একটি পুরানো ভক্সওয়াগন গাড়ি কিনে ফেললাম। দিক নির্ণয়ের জন্য একটি জাপানী খেলনা কম্পাস কেনা হলো। আমাদের সমস্ত প্রস্তুতি ঠিক হয়ে এলো।

ইতিমধ্যে বেলুচ রেজিমেন্টাল সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ওসমান আমার স্ত্রীকে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে আসার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলো। নানা অজুহাত দেখিয়ে আমি তা এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। জুলাই মাসের মাঝামাঝি জেনারেল ইয়াহিয়া, জেনারল হামিদ এবং আরো বেশ কিছুসংখ্যক জেনারেল কাকুল মিলিটারি একাডেমীতে বেশ কিছুদিনের জন্য এসে থাকে। এ সময় গুজব রটে শেখ মুজিবুর রহমানকে আলোচনার জন্য এবোটাবাদ আনা হয়েছে। নিক্সনের উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে নাথিয়াগলিতে শেখ মুজিব ও ড. কামাল হোসেনের আলোচনা হয়েছে বলেও একটা গুজব আমরা শুনতে পাই।

এই সময় আমি সর্বপ্রথম বাড়ি থেকে চিঠি পেলাম। ২৫ শে মার্চের পর এই প্রথম চিঠি। যদিও চিঠিতে বিস্তারিত কিছুই লিখা ছিল না, জানতে পারি, আমার মেয়ে জয়া (নিতু) ৬ এপ্রিল বিপ্লবের মাঝে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। নানা অসুবিধার মধ্য দিয়ে আমার স্ত্রী গ্রামের বাড়িতে দিন কাটাচ্ছে। এই খবর শুনে একটা দুর্বলতা আমাকে পেয়ে বসে, যা কাটিয়ে উঠতে আমার আরও কয়েকদিন সময় লাগে। আরো জানতে পারি আমার ছোট ভাইরা সবাই বাড়িতে এবং আমাদের গ্রামে এখনও পাকিস্তানী সৈন্যের আগমন ঘটেনি। আমার ভাইদের এবং আরও কয়েকজন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় থেকেই আমি গেরিলা যুদ্ধ ও বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহারের শিক্ষা দিয়েছিলাম। এই সব বিষয়ের ওপর বিভিন্ন সামরিক প্যামপ্লেটও আমি তাদের দিয়েছিলাম। ২৫ শে মার্চের আগে ঢাকায় কয়েক হাজার মলোটভ ককটেল ও হ্যান্ড গ্রেনেড তৈরী করে এরা বিভিন্ন দলকে দেয়। বাড়ি থেকে চিঠি পাওয়ার পর আমি তাদেরকে লিখে জানাই, ময়মনসিংহ জেলার মোহনগঞ্জের ভাটি এলাকায় চলে যাওয়ার জন্য।

২২ শে জুলাই আমি পিন্ডি থেকে একটি টেলিফোন কল পাই। টেলিফোনকারী নিজের পরিচয় না দিয়ে আমাকে ব্রিগেডিয়ার খলিলের সঙ্গে দেখা করার কথা বলে টেলিফোন বন্ধ করে দেয়। জুলাই মাস শেষ হওয়ার আগেই আমাদের পালাতে হবে এই পরিকল্পনাই আমরা নিয়েছিলাম। ২৩ শে জুলাই আমার স্ত্রী বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তান ফিরে আসছে বলে আমি ব্রিগেডিয়ার ওসমানকে জানাই। ব্রিগেডিয়ার ওসমান খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠে এবং করাচী যেয়ে আমার স্ত্রীকে নিয়ে আসার জন্য ১০ দিনের ছুটি দেয়। এই ১০ দিনের মধ্যেই আমাদেরকে পশ্চিম পাকিস্তান ছেড়ে পালাতে হবে। ২৩ তারিখ দুপুরে এবোটাবাদ থেকে রওয়ানা হয়ে বিকেলে পিন্ডি পৌঁছি। ২৪ তারিখে ক্যাপ্টেন দেলোয়ারের পিন্ডি পৌঁছার কথা। ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী ইতিমধ্যেই খারিয়া থেকে বদলি হয়ে ঝিলাম চলে এসেছে। আমরা ঠিক করলাম, পাটোয়ারীকে শিয়ালকোট যাওয়ার পথে তুলে নেয়া যাবে। ২৪ তারিখ ভোরে ক্যাপ্টেন দেলোয়ার আমাদের টেলিফোনে জানালো সে এবং সাত্তার সাহেব আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে না। ভাবলাম বোধ হয় ভয় পেয়েছে, তাই মত পাল্টিয়েছে।

সেদিন বিকেলে আমি এবং জিয়াউদ্দিন ব্রিগেডিয়ার খলিলের বাড়ি যাই। ব্রিগেডিয়ার খলিলের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারলাম যে মাঝে এক পাঠান ন্যাপ কর্মীর সহায়তায় তোরখান সীমান্ত দিয়ে কাবুল পৌঁছানো যেতে পারে। কাবুলে ভারতীয় দূতাবাসে সাত্তার সাহেবের পরিচিত এক ভদ্রলোক রয়েছেন, যার সহায়তায় ভারতে পৌঁছানো সম্ভব। সাত্তার ও ক্যাপ্টেন দেলোয়ার ২৫ তারিখ সন্ধ্যায় কাবুল রওয়ানা হচ্ছে। এ কথা শুনে মেজর জিয়াউদ্দিন খুবই উৎফুল্ল হয়ে উঠলো এবং তাদের সঙ্গে যাওয়া সমীচীন মনে করলো। একজন পাঠানকে বিশ্বাস করতে আমার মন সায় দিল না। তাই আমি আমাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী শিয়ালকোটের পথে সীমান্ত অতিক্রম করা যুক্তিযুক্ত হবে বলে মনে করলাম। ব্রিগেডিয়ার খলিলকে বললাম, যদি শিয়ালকোটের পথে পালিয়ে যেতে আমরা ব্যর্থ হই, তবে কাবুলের পথে আবার নতুন করে চেষ্টা শুরু করবো।

ব্রিগেডিয়ার খলিল সাহেবের বাড়ি থেকে এসে আমরা কিছুক্ষণ পিন্ডি ক্লাবে কাটালাম। এরপর চলে যাই পিন্ডি ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে। বেশ রাত হয়ে গেছে, হঠাৎ দেখি ক্যাপ্টেন দেলোয়ার আমাদেরকে খুঁজতে খুঁজতে সেখানে এসে হাজির। সে বললো, সাত্তার সাহেব আমাদের জন্য বাইরে অপেক্ষা করছেন। সাত্তার সাহেবের সঙ্গে আমাদের অনেক আলোচনা হলো। তিনি বললেন, কাবুলে নিরাপদে পৌঁছতে পারবো। তিনি আমাদের খবর পাঠাবেন, যেন আমরা সেই পাঠানের সঙ্গে কাবুল পৌঁছতে পারি। বাঙালি বেসামরিক কর্মচারীদের মধ্যে এই ভদ্রলোকের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের প্রবল স্পৃহা এবং দেশপ্রেম অত্যন্ত প্রশংসার যোগ্য। রাত দু’টায় তাদেরকে শুভ কামনা জানিয়ে আমরা বিদায় নিলাম।

জিয়াউদ্দিনের ঘরে গিয়ে দেখি ক্যাপ্টেন মুজিব ঘুমিয়ে আছে। সে উইক এন্ড কাটাতে এবোটাবাদ থেকে পিন্ডি এসেছে। পশ্চিম পাকিস্তান ঘেঁষা কার্যকলাপের জন্য তাকে আমরা বিশ্বাস করতাম না বরং এ সময় তার উপস্থিতিতে আমরা অত্যন্ত বিরক্ত বোধ করি। কিন্তু কিছু বলারও উপায় ছিল না। ২৫ শে জুলাই ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আস্তে আস্তে জিয়াউদ্দিনকে জাগালাম। সামান্য কিছু জিনিসপত্র আর রিভালবার-গুলি নিয়ে ক্যাপ্টেন মুজিবকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে বেরিয়ে পড়লাম। সদ্য কেনা পুরানো ভক্সওয়াগনটি বেশ ভালই চলছিলো। গুজরানওলার কাছাকাছি এসে আমরা কিছুক্ষণের জন্য থেমে রাস্তার পাশের দোকানে চা খেলাম। পরিচিত কারো সঙ্গে যদি দেখা হয়ে যায় সে জন্য একটি গল্পও তৈরি করে রাখতে হলো। জিয়াউদ্দিন যাচ্ছে লাহোরে ১০ দিনের ছুটি কাটাতে, আমি যাচ্ছি লাহোর থেকে পি. আই. এ.-র নাইট কোচ ধরে করাচী থেকে স্ত্রীকে আনার জন্য।
সকাল ৯টার মধ্যেই ঝিলাম পৌঁছে গেলাম। ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীর ঘরে পৌঁছে দেখি রোববার বলে কয়েকজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারসহ তারা গল্প করছে। তাকে আমাদের নতুন কেনা গাড়িতে নিয়ে বেড়াবো বলে সেখান থেকে উঠিয়ে আনলাম। আমরা এই সপ্তাহে পালাবো বলে ঠিক করেছিলাম কিন্তু কোনদিন যাবো তা পাটোয়ারীকে জানাতে পারিনি, তাই ওকে এক কাপড়ে আমাদের সঙ্গে উঠে আসতে হলো। গাড়িতে বসে যখন তাকে সব জানালাম, সে বললো, ব্যাংকে তার কয়েক হাজার টাকা রয়ে গেছে এবং তা তুলে নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু রোববার বলে ব্যাংক বন্ধ এবং সেখানে আরো একদিন দেরী করা নিরাপদ মনে করলাম না। অবশ্য সে সময় টাকার প্রয়োজনীয়তাও আমরা বিশেষ মনে করিনি। বেলা একটার সময় আমরা শিয়ালকোট সীমান্ত রাস্তায় পৌঁছলাম। সেখানে গাড়ি ছেড়ে ৯ মাইল পায়ে হেঁটে সীমান্ত অতিক্রম করতে হবে। ভাবলাম দিনের বেলা জায়গাটা একটু দেখে নেয়া যাক।

সেই এলাকায় সে সময় পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি ব্যাটালিয়ন ও একটি আর্টিলারি রেজিমেন্ট সীমান্ত রক্ষায় নিয়োজিত ছিল। রাতের অন্ধকারে এই প্রতিরক্ষা ব্যুহের মাঝখান দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতে পারবো বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। সন্ধ্যা হওয়ার এখনও কয়েক ঘণ্টা বাকি। শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্ট কাছেই। মেজর মঞ্জুর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) সে সময় শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্টে থাকতো। ভাবলাম দিনটা মেজর মঞ্জুরের বাড়িতে কাটানো যাক। সীমান্ত রাস্তাটি দেখা শেষ করে বেলা আড়াইটার সময় আমরা মেজর মঞ্জুরের বাড়িতে পৌঁছলাম। মঞ্জুরের সঙ্গে অনেক আলাপ-আলোচনা হলো। শেষ পর্যন্ত আমাদের পালাবার পরিকল্পনা তাকে বললাম এবং তাকেও আমাদের সঙ্গী হতে অনুরোধ জানালাম। মঞ্জুরের স্ত্রী, তিন বৎসরের মেয়ে ও কয়েক মাসের একটি ছেলে সে সময় তার সাথেই ছিলো। এ অবস্থায় পালানো মঞ্জুর বিপজ্জনক মনে করলো এবং আমাদের সাথে যেতে রাজি হলো না। কিন্তু মঞ্জুরের স্ত্রী আমাদের সাথে আসার জন্য জেদ ধরে বসলো। এ সময় মঞ্জুর আমাদেরকে বললো, আমাদের পরিকল্পিত রাস্তায় না যেয়ে শিয়ালকোট-জাফরওয়াল রাস্তা দিয়ে গেলে সীমান্ত অতিক্রম করা আরো সহজ হবে। সে এলাকার একটি ম্যাপ এনে আমাদের দেখালো। শিয়ালকোট-জাফরওয়াল সীমান্ত রাস্তার এক জায়গায় ভারত সীমান্ত খুবই নিকটে এবং সে স্থান দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম সহজ হবে।

সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, মঞ্জুর এখনো মন স্থির করতে পারছে না। মঞ্জুরের স্ত্রী যদি পীড়াপীড়ি না করতো এবং সাহস না দেখাতো তা হলে তারা কোনদিনই আমাদের সাথে আসতে পারতো না। রাত সাড়ে আটটা, তখনও মঞ্জুর যাবে কি যাবে না তাই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। বিরক্ত হয়ে বল্লাম, আমাদের সময় নষ্ট করে লাভ নেই, আলোচনারও আর প্রয়োজন নেই। ৯টার মধ্যেই আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে। তাড়াতাড়ি সবাই কিছু খেয়ে নিলো। এরপর বিপদ হলো মঞ্জুরের ব্যাটম্যান আলমগীর খানকে নিয়ে। আলমগীর খান বাঙালি, তখন পর্যন্ত তাকে কিছুই বলা হয়নি। বললে তার কী প্রতিক্রিয়া হবে, সে সম্বন্ধে মঞ্জুরের মনে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল, কিন্তু না বলেও উপায় নেই। বলার সঙ্গে সঙ্গে সে আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য তৈরী হয়ে নিলো। ছুটিতে বাড়ি এসে বিয়ে করবে বলে ভাবি বঁধুর জন্য সে বেশ কয়েকটি শাড়ী কিনেছিলো। তাই গুছিয়ে নিলো আর সঙ্গে নিলো একটি বড় ছুরি।

রাত পৌনে ৯টায় কোনো রকমে চাপাচাপি করে আমরা গাড়িতে বসে রওয়ানা হলাম। চলার পূর্বে মিসেস মঞ্জুর বাচ্চা দুটোকে শান্ত রাখার জন্য স্লিপিং পিল খাইয়ে দিলেন। মিসেস মঞ্জুর একটি বোরকা পরে নিলেন, যাতে করে কারো সন্দেহের উদ্রেক না হয়। শিয়ালকোট থেকে জাফরওয়ালের পথে চলছি। রাতটি ছিল ভীষণ অন্ধকার, অল্প অল্প বৃষ্টিও পড়ছে। পালাবার জন্য এক উপযুক্ত প্রাকৃতিক পরিবেশ। শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্ট পার হবার পরই একটি এমপি চেকপোস্ট আমাদের অতিক্রম করতে হবে। আমরা ভাব দেখাচ্ছিলাম যেন সেখানকারই বাসিন্দা, জাফরওয়াল বেড়াতে যাচ্ছি, সাধারণ বেশ কয়েকটি পাঞ্জাবী শব্দও রপ্ত করে নিয়েছিলাম, যেন কারও সন্দেহের উদ্রেক না হয়। ভাগ্যক্রমে বৃষ্টি হচ্ছিল বলে চেকপোস্টের মিলিটারী পুলিশ বাইরে না দাঁড়িয়ে চেকপোস্টের ভেতরে বসে ছিল ও আমাদের গাড়ি চেক করার জন্য দাঁড় করালো না।

শিয়ালকোট-জাফরওয়ালের মাঝামাঝি জায়গায় রাত পৌনে দশটায় পৌঁছে গেলাম। গাড়ি দাঁড়ালো, কিন্তু কেউ নামছেন না। এখনও আমরা শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতে পারি। কেউ আমাদের কোন সন্দেহ করবে না। পেছনে তাকিয়ে মনে হলো যেন একটা গাড়ি আসছে। তাড়াতাড়ি সবাই গাড়ি থেমে নেমে মাঠের পথে ভারত সীমান্তের দিকে চলতে শুরু করলাম। শিয়ালকোট জায়গাটি অত্যন্ত নীচু। ভাল ধান জন্মে বলে এই জায়গার খ্যাতি আছে। মাঠ তাই কর্দমাক্ত। ১০-১৫ গজ চলার পর আমরা রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেলাম। জাপানী খেলনা কম্পাসটি সেদিন আমাদের বেশ কাজে আসে। সোজা উত্তর দিকে দু’মাইল গেলে আমরা সীমান্ত অতিক্রম করবো। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। দিক নির্ণয়ের জন্য ধ্রুবতারাটিও আকাশে দেখা যাচ্ছে না। এক হাতে কম্পাস এবং অন্য হাতে রিভলবার নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ চলার পর মিসেস মঞ্জুরের একটি ক্যানভাসের জুতো যে কাদার ভেতর ঢুকলো তা আর বেরিয়ে এলো না। খালি পায়ে হাঁটা সেখানে অত্যন্ত কষ্টকর। ভদ্রমহিলাকে আমাদের কাঁধে ভর করতে হলো।

পাকিস্তানী দু’টি সীমান্ত ঘাঁটির মাঝামাঝি রাস্তা দিয়ে আমরা সীমান্ত অতিক্রমের পথ বেছে নিয়েছিলাম। ঘণ্টাখানেক চলার পর আমি নিশ্চিন্ত হলাম, আমরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেছি। মেজর মঞ্জুর বিভিন্ন কাজে এই সীমান্তে পূর্বে কয়েকবার এসেছিলো। সে বলতে লাগলো, আমাদের আরো ডান দিকে যেতে হবে এবং আমরা এখনও সীমান্ত অতিক্রম করিনি। তাঁর পীড়াপীড়িতে বাধ্য হয়েই আমরা ডান দিকে চলতে শুরু করলাম। প্রায় এক ঘণ্টা চলার পর হঠাৎ করে আমরা দেখতে পেলাম আমাদের সামনেই একটি সীমান্ত ঘাঁটি। সবাইকে ঝোঁপের আড়ালে বসিয়ে রেখে আমি এগিয়ে গেলাম। একটি সীমান্ত খুঁটি আমার নজরে পড়লো। এই ঘাঁটিটি ছিল পাকিস্তানী সীমান্ত ঘাঁটি। নিঃশব্দে ফিরে এলাম। সবাইকে নিয়ে আস্তে আস্তে আবার ভারতের দিকে চলতে শুরু করলাম।

আমরা এবার ঠিক করে নিয়েছি ভারতের বেশ কয়েক মাইল ভেতরে চলে যেতে হবে। যে কোন মুহূর্তে সীমান্ত টহলদার বাহিনী সামনে পড়তে পারে। সে অঞ্চলের গ্রামবাসীরা ক্ষেতের কাজের জন্য মাঠের মধ্যেই ছোট ছোট ঘর বানিয়ে থাকতো। তাদের সামনে পড়াও বিচিত্র ছিল না। এ সমস্ত পরিস্থিতির মোকাবিলা করার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের ছিল, কিন্তু ভয় ছিল কেবল মিসেস মঞ্জুর আর তার বাচ্চাদের জন্য। রাত দু’টোর সময় একটা শুকনো খালের পাড়ে আমরা উপস্থিত হলাম। খালের ভেতর বসে টর্চ জ্বালিয়ে আবার ম্যাপটি ভাল করে দেখা হলো। এবার আমরা ভুল করিনি। সীমান্ত থেকে ৩ মাইল ভেতরে চলে এসেছি। কয়েক শত গজ দূরেই ভারতীয় সীমান্ত ঘাঁটি দেবীগড়। মিসেস মঞ্জুর তার বাচ্চাদের একটি গাছের নীচে শুইয়ে দিলেন। ভোরের প্রত্যাশায় আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
সূত্র:
হারুন হাবীব সম্পাদিত ‘প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ’ শীর্ষক গ্রন্থ থেকে সংগৃহীত।

bottom of page