উচ্চ আদালতে ইনু
কর্নেল তাহের হত্যাকা- মামলা: উচ্চ আদালতে জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু এর বক্তব্য
২৪ নভেম্বর ১৯৭৫ সনে গ্রেফতারের পর ৬ ডিসেম্বর কর্নেল তাহেরকে ঢাকা থেকে রাজশাহী কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর সামরিক কর্তৃপক্ষ তাহেরকে সমগ্র দেশবাসী এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে থেকেও বিচ্ছিন্ন রাখার চেষ্টা করেছে।
হঠাৎ করেই কর্নেল তাহের জানতে পারলেন যে, তাঁকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তখনই তিনি ধারণা করতে পেরেছিলেন যে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। ২২ মে ১৯৭৬ তাহেরকে রাজশাহী কারাগার থেকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আনা হয় বিশেষ সতর্কতার সঙ্গে।
১৪ জুন ১৯৭৬ সালে ‘Special Martial Law Tribunal Regulation 1976’ শিরোনামে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম এক অধ্যাদেশ জারি করেন সামরিক শাসন জারি করার ঠিক দশ মাস পরে। গঠিত হয় ১নং বিশেষ সামরিক ট্রাইব্যুনাল।
১৫ জুন ১৯৭৬ সরকার ‘বাংলাদেশ টাইমস’ এর পিছনের পাতায় ছোট্ট করে একটি আইন বিজ্ঞপ্তি প্রচার করে এবং তাতে ১১ জনকে ২১ জুনের মধ্যে ‘Special Martial Law Tribunal’ এর সামনে হাজির হতে আদেশ দেয়া হয়, অন্যথায় তাদের অনুপস্থিতিতে বিচার পরিচালিত হবে বলে উল্লে¬খ করা হয়। এই ১১ জনের মধ্যে ৭ জনই হচ্ছেন সৈনিক, যারা সিপাহী বিদ্রোহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। সিরাজুল আলম খান, শরীফ নূরুল আম্বিয়াসহ বাকি ৪ জনই হচ্ছেন জাসদের গুরুত্বপূর্ণ নেতা।
দৈনিক ইত্তেফাক অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে দেশবাসীকে জানিয়ে দিল শেষ পৃষ্ঠায় এক ইঞ্চি একটি সংবাদ ছাপিয়ে, যার শিরোনাম ছিল ‘ষড়যন্ত্র মামলার শুরু’। এর জন্য ইত্তেফাক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে ক্যান্টনমেন্টে ডেকে নিয়ে যায় সামরিক কর্তৃপক্ষ। তাঁকে সতর্ক করে দেয়া হয়। এটা সবার কাছেই স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে যে অধ্যাদেশটি জারির একটাই উদ্দেশ্য ছিল। আর তা হলো, সামরিক আইনের আওতায় কর্নেল তাহেরকে হত্যা করার কাজটি নির্বিঘেœ সম্পন্ন করা।
এই বিশেষ সামরিক অধ্যাদেশের ৩ ও ৪নং উপধারায় ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক যেসব অপরাধের বিচার করা যাবে তা হচ্ছে-১৮৬০ সালের পেনাল কোড এর ৬ষ্ঠ অধ্যায়ের ৭ম ধারার অপরাধগুলো তথা (১) রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ (২) Offences against the Army, The Navy, The Air Force (৩) Army Act 1952, Air Force Act 1953, Navy Ordinace 1961 or Any Rules or regulations There Under-সে সমস্ত অপরাধ। এ ছাড়াও সামরিক আইন ১৯৭৫-এর ১৩শ ও ১৭শ ধারার আওতায় সকল অপরাধের বিচার। সে অপরাধগুলো যথাক্রমে বিদ্রোহ করার জন্য সামরিক বাহিনীকে প্ররোচনা দেয়া এবং রাষ্ট্রের জন্য অনিষ্টকর যে কোনো কাজ। ইদানিংকালের ইতিহাসে এত ক্ষমতাধর ট্রাইব্যুনাল আর গঠন হয়নি। এই ট্রাইব্যুনালের আওতায় তিন ধরনের আইনের বিরুদ্ধে অপরাধ (১) সাধারণ আইনের অপরাধ (২) সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে অপরাধ (৩) সামরিক আইনের বিরুদ্ধে অপরাধ-এর বিচার করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছিল।
ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা হলেন-চেয়ারম্যান-কর্নেল ইউসুফ হায়দার, সদস্যগণ-(১) যশোর বিমান ঘাঁটির উইং কমান্ডার মোহাম্মদ আবদুর রশীদ, (২) নৌ-বাহিনীর সদর দফতরের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার সিদ্দিক আহমদ, (৩) ঢাকা দক্ষিণের প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট আবদুল আলী, (৫) ঢাকা উত্তরের প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট হাসান মোর্শেদ। প্রচলিত রীতিতে মার্শাল ল’ কোর্টে বিচার বিভাগ থেকে বিচারক নেয়া হয়, যেমন-সেশন জজ, অতিরিক্ত সেশন জজ প্রমুখদের। লক্ষ্যণীয় যে, পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট এই ট্রাইব্যুনালের সবাই সশস্ত্র বাহিনীর ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা। বিচারের জন্য ন্যূনতম নিরপেক্ষতা বজায় রাখারও কোনো চেষ্টা সায়েম-জিয়া সরকার করেননি। এ সকল ত্রুটি নিয়েই বিচারের কাজ শুরু হয়।
কর্নেল ইউসুফ হায়দারের ট্রাইব্যুনালের সদস্যগণ ১৫ জুন ১৯৭৬ ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করেন। জেলখানার অভ্যন্তরে ডিআইজি সাহেবের কক্ষকে ‘আদালত কক্ষ’ করার সিদ্ধান্ত দেন। আদালত ঘরটি অত্যন্ত ছোট। লোহার জাল দিয়ে ঘরটাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। অভিযুক্তদের বসার ব্যবস্থা করা হয় সেই লোহার খাঁচার ভেতরে। খাঁচার বাইরে আইনজ্ঞদের বসার স্থান এবং তারপর কোর্টের মত করে ট্রাইব্যুনাল সদস্যদের বসার ব্যবস্থা করা হয়।
১৯৭৬ সালের জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সমস্ত কর্তৃত্ব সেনাবাহিনী গ্রহণ করে। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সেনা সদস্যরা কারাগারের চারপাশে পাহারায় বসে। এমনকি কারাগারের অভ্যন্তরেও সেনা সদস্যদের অস্ত্রসহ পাহারায় মোতায়েন করা হয়। কারগারের বিধি অনুযায়ী কোনো অস্ত্রধারীকে কারা অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেয়া হয় না। এ সময়ে অস্ত্রধারীদের মোতায়েন করার জন্য কোনো সামরিক আইনের বিধিও জারি করা হয়নি। সুতরাং এভাবে কারাগারে সশস্ত্র সেনা মোতায়েন ছিল সম্পূর্ণ বেআইনি। কিন্তু তৎকালীন সামরিক জান্তা ক্ষমতার মোহে খুনের নেশায় মত্ত হয়ে কারাগারের চলতি আইন রদ করে কিংবা নতুন আইন প্রণয়নের ধৈর্যটুকুও হারিয়ে ফেলে এবং ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার দখল করে নেয়। এই প্রস্তুতি ছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে একটি ন্যাক্কারজনক প্রহসনমূলক গোপন বিচার অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধান করার জন্য।
খাঁচার ভেতরেও বন্দীদের হাতকড়া পরা অবস্থায় রাখা হোল। কর্তৃপক্ষ এতই ভীত ছিল যে, শুধু হাতকড়ার ওপর ভরসা রাখতে পারেনি। খাঁচার বাইরেও এঁটে দেয়া হলো মস্ত বড় তালা। আদালত কক্ষে ঢোকানোর কিছু পরে আইনজ্ঞরা এলেন। এই প্রথম অভিযুক্তদের সঙ্গে আইনজীবীদের সাক্ষাৎ হোল। কি অভিযোগ, কিসের বিচারÑতার কিছুই আগে জানানো হয়নি। প্রচলিত আইনে এসব হচ্ছে পুরোপুরি বেআইনি। এমনকি সামরিক আইন এবং সামরিক আদালতে বিচারের ক্ষেত্রে এই আচরণ সম্পূর্ণ বিধি বহিঃভূত। কিন্তু জিয়ার নেতৃত্বাধীন সামরিক জান্তার উদ্দেশ্য আসলে বিচার ছিল না, ছিল অন্য কিছু।
কর্নেল তাহের, মেজর এম এ জলিল, আ স ম আবদুর রব, সিরাজুল আলম খান এবং আমাকেসহ মোট ৩৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়। বাকিরা হচ্ছেন: ৬. জাতীয় শ্রমিক লীগ সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহান, ৭. শরীফ নূরুল আম্বিয়া, ৮. বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. আখলাকুর রহমান, ৯. ছাত্রলীগ সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, ১০. কর্নেল তাহেরের ছোট ভাই প্রভাষক আনোয়ার হোসেন ১১. ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল এবং ১২. আবু ইউসুফ খান, ১৩. যশোরের জাসদ নেতা রবিউল আলম, ১৪. সালেহা বেগম, ১৫. ‘ওয়েভ’ সম্পাদক কে বি এম মাহমুদ, ১৬. প্রকৌশলী আনোয়ার সিদ্দিক, ১৭. মহিউদ্দিন, ১৮. মেজর জিয়াউদ্দিন, ১৯. কর্পোরাল আলতাফ হোসেন, ২০. কর্পোরাল শামসুল হক, ২১. নায়েব সুবেদার মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন, ২২. হাবিলদার এম এ বারেক, ২৩. নায়েক সিদ্দিকুর রহমান, ২৪. কর্পোরাল এম এ মজিদ, ২৫. হাবিলদার আবদুল হাই মজুমদার, ২৬. নায়েব সুবেদার বজলুর রহমান, ২৭. হাবিলদার সুলতান আহমদ, ২৮. নায়েক এ বারী, ২৯. সার্জেন্ট কাজী এ কাদের, ৩০. ওয়ারেন্ট অফিসার কাজী রোকনুদ্দিন, ৩১. নায়েক শামসুদ্দিন, ৩২. সার্জেন্ট সৈয়দ রফিকুল ইসলাম, ৩৩. নায়েব সুবেদার আবদুল লতিফ আকন্দ। এঁরা সবাই সিপাহী বিদ্রোহের সামনের কাতারের নেতা।
২১ জুন ১৯৭৬ সকাল ১০টায় কারাগারে গোপন বিচার শুরু হয়। ঐ একই সময়ের আরেকটি ঘটনার উল্লে¬খ করা দরকার। আমরা অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, খালেদের অন্যতম সহযোগী কারাগারে আটক কর্নেল শাফায়াৎ জামিলসহ আরো কতিপয় অফিসারদের মুক্ত করে দেয়া হলো। খালেদের সহযোগীদের সঙ্গে জিয়ার কি আপস-রফা হয়েছিল তা জানি না। তবে তাহেরকে যখন হত্যা করার পরিকল্পনা জিয়া কার্যকর করতে যাচ্ছেন, তখন তিনি খালেদের সহযোগীদের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলছেন। ‘ভারত বিরোধী’ জিয়ার ক্ষমতা রক্ষার জন্য ‘ভারতপন্থী’দের আপস করতে কোনো অসুবিধা হোল না। ক্ষমতা রক্ষা করতে হবে, পুরানো আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও স্বৈরাচারী শাসন রক্ষা করতে হলে তাহেরকে ধ্বংস করতে হবে এবং এত নীতি নৈতিকতার কোনো প্রয়োজন নেই। সেজন্য কি অদ্ভুত ঘটনা, কর্নেল শাফায়াৎ জামিল তাঁর দলবল নিয়ে যে সময়ে জিয়ার খাতিরে নাকি অনুকম্পায় মুক্ত হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের বাইরে পার হলেন, ঠিক সেসময়ে কারাগারের অভ্যন্তরে শুরু হলো ঐতিহাসিক সিপাহী বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দেরÑতথা কর্নেল তাহেরকে হত্যা করার জন্য গোপনে বিচারের নামে প্রহসন।
২১ জুন ৭৬’ এর সকালে কারা কর্তৃপক্ষ জানালেন, তাহেরসহ আমাদের সবাইকে আদালতে হাজির হতে হবে। প্রত্যেককে হাতকড়া পরতে হবে, পায়ে জুতো পরা চলবে না, যেতে হবে খালি পায়ে। এভাবে যেতে আমরা সবাই আপত্তি করলাম। বন্দুকের মুখে তাহেরসহ সবাইকে টেনে-হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো। কর্নেল তাহের মুক্তিযুদ্ধে একটি পা হারিয়েছিলেন। তাঁর হাঁটার লাঠিটাও সঙ্গে নিতে দেয়া হলো না। রক্ষীরা তাঁকে বয়ে নিয়ে গেল ‘আদালত কক্ষের লোহার খাঁচায়’।
ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান অভিযোগগুলো পড়ে শোনালেন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, ‘কর্নেল তাহের…সহ ব্যক্তিবর্গ ১৯৭৩ সন থেকে ১৯৭৫ এর নভেম্বর পর্যন্ত আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারকে বল প্রয়োগের মাধ্যমে উৎখাত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য তৎপরতা চালায়। এর জন্য জনগণের মধ্যে এবং সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে সমাজ বিপ্ল¬বের জন্য বিভিন্নভাবে তৎপরতা চালায়’।
আইনজ্ঞরা আমাদের পক্ষে ওকালতি করার সুযোগ পাবেন, যদি তারা আদালতের ও মামলার সকল কার্যক্রম গোপন রাখতে প্রতিজ্ঞা করেন। এই শর্ত ভঙ্গ করলে আইনজ্ঞদের তিন বছরের কারাদ- ভোগ করতে হবে। বিচারের নামে যে প্রহসন শুরু হতে যাচ্ছে তার সাক্ষী হয়ে থাকার জন্যই কেবল সম্মানিত আইনবিদগণ ঐ জঘন্য শর্ত মেনে নিয়ে সামরিক আদালতের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেন। সর্বজনাব আতাউর রহমান খান (পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক চিফ মিনিস্টার), জুলমত আলী খান, আমিনুল হক (পরে অ্যাটর্নি জেনারেল), সিরাজুল হক, কে জেড আলম, জিন্নাত আলী, এ কে মুজিবুর রহমান, মহিউদ্দিন, গাজীউল হক, আবদুল মালিক, আবদুর রউফ, ব্যারিস্টার কাজী শাহাদত হোসেন, আবদুল হাকিম, শামসুর রহমানসহ প্রায় ৩০ জন আইনবিদ এভাবেই ঐ প্রহসনের সাক্ষী হয়ে রইলেন। আইনবিদদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জনাব আতাউর রহমান খান, জুলমত আলী খান, আমিনুল হক, গাজীউল হক প্রমুখরা। অভিযোগপত্রের ব্যাখ্যা চেয়ে রাজনীতিবিদ ও বিশিষ্ট আইনজীবী জনাব আতাউর রহমান খান বলেন, ‘…১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি সরকার ক্ষমতায় ছিল। ১৫ আগষ্ট ৭৫ পর্যন্ত শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাকশাল সরকার, ১৫ আগষ্ট ৭৫ থেকে ৩ নভেম্বর ৭৫ পর্যন্ত খন্দকার মোস্তাকের নেতৃত্বে সামরিক সরকার, ৩ নভেম্বর ৭৫-এর পর খালেদের নেতৃত্বে সায়েমের সামরিক সরকার এবং সর্বশেষ ৭ নভেম্বরের পর জেনারেল জিয়ার সমর্থনে বিচারপতি সায়েম ক্ষমতায় আসেন। শেখ মুজিবের সরকারকে উৎখাত করা হয় বল প্রয়োগের মাধ্যমে এবং তারপর থেকে প্রত্যেকটি সরকারই ক্ষমতায় আসে সশস্ত্র কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে। এই ধারাবাহিক সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় কর্নেল তাহেরসহ অভিযুক্ত নেতৃবৃন্দ কখনো ক্ষমতা দখল করেননি এবং ক্ষমতায় যারা এসেছেন তারাই দম্ভভরে উৎখাতের দায়িত্ব স্বীকার করেছেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫-এর নভেম্বর পর্যন্ত কোনো নির্দিষ্ট সরকারকে উৎখাত করার প্রচেষ্টা অভিযুক্তরা চালিয়েছিল, তা অভিযোগপত্রে উল্লে¬খ করা হয়নি বিধায় উল্লে¬খিত অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হতে পারে না এবং উক্ত অনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিচারও করা যায় না।’ জনাব খানের এই বক্তব্যের কোনো উত্তর না দিয়েই অথবা অভিযোগ সুনির্দিষ্ট করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ না করেই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারের কাজ চালানোর নির্দেশ দেন। বিচারের প্রথম দিনের শুরুতেই এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, এই আদালতের উদ্দেশ্য আসলে বিচার নয়, সামরিক জান্তার বিশেষ উদ্দেশ্য কার্যকর করার জন্য জল্লাদের ভূমিকা পালন মাত্র। সরকারের এই মামলা সাজাতে সময় লাগে প্রায় ৬ মাস। আর আমাদের উকিলদের মামলার কাগজপত্র পরীক্ষা করতে ও আত্মপক্ষ সমর্থনে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির জন্য সময় দেয়া হয় মাত্র ৮ দিন। ২১ জুনের পর ট্রাইব্যুনাল মুলতবি হয় মাত্র ৮ দিনের জন্য। উকিলদের সঙ্গে আদালতের সময়কালের বাইরে দেখা সাক্ষাতের কোনো অনুমতি ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে বা একান্তে আলোচনার কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি। গ্রেফতারের পর থেকে আদালতে হাজির হওয়া পর্যন্ত আমি বা কর্নেল তাহেরসহ কোনো বন্দীর সঙ্গে আত্মীয়-স্বজনদের দেখা করার কোনো অনুমতি দেয়নি। একেবারে পুরো নির্বাসন। এমনকি অভিযোগের পক্ষে যে সমস্ত প্রমাণাদি রেকর্ড করা হয় সেগুলোর কপি পর্যন্ত আইনজীবীদের দেয়া হয়নি।
আত্মপক্ষ সমর্থনের সময় কত দেয়া যেতে পারে সে ব্যাপারে বিচারপতি মোহাম্মদ মুনীরের একটি বিখ্যাত রায় আছে। সেই রায়ে তিনি বলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ কোন মামলায় আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কম সময় বরাদ্দ করা হলে তা বিচারের ফলাফলের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে এবং সেক্ষেত্রে বিচারের গুণাগুণের ওপর জনগণের আস্থা নষ্ট হতে বাধ্য’। কর্নেল তাহেরের মামলা নিশ্চয়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
সাক্ষী ছিল ৭ জন। যারা প্রত্যেকেই ছিল সহ-অভিযুক্ত। অর্থাৎ তাদের রাজসাক্ষী বানানো হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের এক দিন পর অর্থাৎ ১৫ জুন ৭৬ তাদের ক্ষমা প্রদর্শন করা হয়। সেই ৭ জন সবাই সিপাহী বিদ্রোহের সামনের কাতারের নেতা ও সংগঠক ছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন, নায়েব সুবেদার মাহবুবুর রহমান, কর্পোরাল ফখরুল আলম, কর্পোরাল জুবের আনসারী, ল্যান্স নায়েক বারী, কর্পোরাল মোজাম্মেল হক, কর্পোরাল মোয়াজ্জেম হোসেন। তাঁদের গ্রেফতার করার পর অমানসিক নির্যাতন করা হয়। যা লিখে দেয়া হয় তাই তারা আদালতে পড়ে দেয়। জেরার জবাবও দিতে পারেনি। তাহের হত্যার পর তাঁদের সবাইকে জিয়া বিদেশি দূতাবাসে চাকুরি দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়। পরে তাঁরা দূতাবাসের চাকুরি থেকে পালায় এবং জিয়ার বিরুদ্ধে আবার ভূমিকা গ্রহণ করে। এসব ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণ হয় যে, তাঁদের রাজসাক্ষী হতে বাধ্য করা হয়। এ ছাড়াও আরেকটি আইনের বাইরের কাজ হয়, তা হোল সাধারণত যারা রাজসাক্ষী হয়, তাদের বক্তব্যকে কোনো আদালত সত্য বলে গ্রহণ করে না। সেজন্য রাজসাক্ষীদের বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করার জন্য প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য লাগে।
এই গোপন আদালতের কার্যক্রম ছিল একঘেঁয়ে গৎ বাধা। আদালতের কোনো নিয়ম-কানুনই মানা হয়নি। শুরু থেকেই ছিল তড়িঘড়ি করে শেষ করার প্রবণতা। আদালতের বিরুদ্ধে আইনজ্ঞগণ বারবার প্রতিবাদ তোলেন এবং তা লিপিবদ্ধ করতে আদালতকে বাধ্য করেন। বিচারে রাজসাক্ষীর বাইরে কোনো স্বাধীন সাক্ষী ছিল না। সরকারের উত্থাপিত অভিযোগের প্রশ্নেও রাজসাক্ষীদের জবানবন্দিতে তেমন কোনো উল্লে¬খ ছিল না। বরং তারাই বলেছে ষড়যন্ত্র থেকে দেশ ও সেনাবাহিনীকে রক্ষা করার জন্যই ১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বর কর্নেল তাহেরের নির্দেশে সিপাহী অভ্যুত্থান সংগঠিত হয়। আইনত শুধুমাত্র রাজসাক্ষীদের বক্তব্যের ভিত্তিতে কোনো আদালতই অভিযুক্তদের শাস্তি প্রদান করতে পারে না। বড় ধরনের সাজা দেয়ারতো প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু কার্যত তাই করা হোল। অভিযুক্তদের জবানবন্দি দিতে বলা হলেও তা শোনার মতো ধৈর্য্য বিচারকদের ছিল না। জবানবন্দি দেবার সময়ও বাধা দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালের বাধাবিপত্তি কাটিয়ে কর্নেল তাহের মাত্র ৬ ঘণ্টার জবানবন্দি দিতে পেরেছিলেন। অভিযুক্ত নেতৃবৃন্দ তাদের স্বপক্ষে যেসব সাক্ষীদের আদালতে আনার কথা বলেন, তাদেরকে হাজির করার কোনো নির্দেশও দেয়া হয়নি। সামরিক আদালতের এহেন আচরণ আইনজীবীদের ভাবিয়ে তুলছিলো। কিন্তু করার ছিল না কিছুই। পত্রিকায় কোনো খবর ছাপাতে দেয়া হচ্ছিল না। রাজনৈতিক দল বিধির আওতায় তখন বহু রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে সীমিত আকারে কাজ শুরু করেছিল। রাজনৈতিক অঙ্গনের সকল নেতৃবৃন্দই জানতেন গোপন বিচারের কথা। কিন্তু কেউ টু শব্দটি করেননি। তবে তখন তারা গণতন্ত্রের কথা বলছিলেন। অভিযুক্তদের সুষ্ঠু বিচার হোক। এ কথা যারা বলতে চায় না, তারা বহু ধরনের মতের প্রবক্তা হতে পারেন। কিন্তু তারা গণতন্ত্রমনা নন অবশ্যই। এটা অত্যন্ত দুঃখের এবং লজ্জারও ব্যাপার যে, তখন মাওলানা ভাসানী বেঁচে ছিলেন। রাজনীতিতে সক্রিয়ও ছিলেন। গোপন বিচারের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি একটি কথাও বলেননি। তবে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ-াদেশ ঘোষণা হয়ে যাবার পর লুৎফা তাহের যখন সন্তোষে মাওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করেন কিছু একটা করার, তখন মাওলানা ভাসানী রাষ্ট্রপতি সায়েমের কাছে একটি টেলিগ্রাম করেছিলেন।
এই মামলার রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চতর কর্তৃপক্ষের নিকট আপিল করার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। তবে মৃত্যুদ- কার্যকর করার পূর্বে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নেবার বিধান রাখা হয়।
অভিযোগ যেখানে রাষ্ট্রদ্রোহিতার এবং সশস্ত্র অভ্যুত্থানের, অভিযোগ যেখানে সরকার উৎখাতের আর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার, সেখানে নিশ্চয়ই তাড়াহুড়োর কোনো অবকাশ থাকার কথা নয়। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করা দরকার। আর ন্যায় বিচারের জন্য দরকার সত্য উদঘাটন এবং এজন্যই সাক্ষীদের জেরা পাল্টা জেরা করার বিষয়টি ছিলো অন্যান্য যে কোনো বিচারানুষ্ঠানের মতোই অত্যন্ত জরুরি ও অপরিহার্য ব্যাপার। কিন্তু এই আদালতের বিচারকগণ কোনো কিছুই শুনছিলেন না। বিচারের রায় ঘোষণা করার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাই বিচার শুরু করার মাত্র ৩২ দিন পর ১৭ জুলাই ১৯৭৬ সন বিকাল ৪টার দিকে রায় ঘোষণা করা হয়।
কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ-, মেজর জলিল এবং আবু ইউসুফ খানের যাবজ্জীবন কারাদ- ও সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত। মেজর জিয়ার বারো বছরের কারাদ- ও জরিমানা অনাদায়ে আরো ২ বছরের কারাদ-। আ স ম আবদুর রব, হাসানুল হক ইনু ও আনোয়ার হোসেনের ১০ বছর কারাদ- ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে আরো ২ বছরের কারাদ-। সিরাজুল আলম খানের অনুপস্থিতিতে ৭ বছরের কারাদ-। সালেহা ও রবিউল আলমকে ৫ বছর এবং নায়েক সিদ্দিকুর রহমানকে ৩ বছরের কারাদ- দেয়া হয়। অন্যান্যদের দেয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদি কারাদ-। ড. আখলাকুর রহমান, মো. শাহজাহান, শরীফ নূরুল আম্বিয়া (অনুপস্থিত), মাহমুদুর রহমান মান্নাসহ ১৩ জনকে বেকসুর খালাস দেয়া হয়। কিন্তু এদের কেউই তখন কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন না। বিশেষ ক্ষমতা আইনে তাঁদের বহুদিন আটক করে রাখা হয়। সামরিক ট্রাইব্যুনাল সর্বশেষে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ- ঘোষণা করে বেত্রাহত কুকুরের মতো বিচারকক্ষ থেকে পালিয়ে যায়। হঠাৎ সাংবাদিক মাহমুদ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। তাহের তাঁকে সান্তনা দিতে চেষ্টা করলেন। মাহমুদ বলে¬ন, আমার কান্না এ জন্য যে, একজন বাঙালি কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ- রায় ঘোষণা করতে পারলো।
ঐ ছোট্ট লোহার খাঁচার মধ্যে জলিল, রবসহ সবার একটাই কথা ছিল কেন আমাদেরকেও মৃত্যুদ- দেয়া হলো না। হঠাৎ সবাই মিলে আমরা স্লোগান ধরলাম ‘তাহের ভাই লাল সালাম’। সমস্ত জেলখানা যেন কেঁপে উঠল।
রায় শুনে আইনজীবীগণ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান। কারণ এই সামরিক আদালত সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে তার কাজ চালিয়েছে এবং রায় দিয়েছে। আইনজীবীগণ রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করার কথা বলেন। কিন্তু তাহের আবেদন না করার অনুরোধ করেন। সবাই একে একে বিদায় নেন। সবশেষে কর্নেল তাহেরকে নিয়ে যাওয়া হয় ফাঁসির আসামিদের জন্য নির্ধারিত স্থান ৮ নম্বর সেলে।
রায় ঘোষণার মাত্র ৫ ঘণ্টার মধ্যে তাড়াহুড়ো করে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান মামলার সমস্ত কাগজপত্র নিয়ে বঙ্গভবনে যান। সেখানে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয় রাত ৮ টার দিকে। আইন ও বিচার মন্ত্রণালয়ের সচিবকে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে মৌখিক আদেশ দেয়া হয়। রায়ের ওপর প্রতিবেদনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়, যাতে করে দ-াদেশপ্রাপ্ত সবার শাস্তিকেই সমর্থন জানানো হয়। প্রতিবেদন জমা দেবার সময় বেঁধে দেয়া হয় পর দিন ১৮ জুলাই ৭৬’ সকাল বেলা। কিন্তু পর দিন ১৮ জুলাই ছিলো রবিবার ছুটির দিন। এত অল্প সময়ে মন্তব্যসহ প্রতিবেদন তৈরি করা সম্ভব নয় বিধায় সচিব মহোদয় চতুরতার সঙ্গে কুশলী ভাষায় রিভিউ রিপোর্টে লেখেন ‘The evidence as analyzed by the tribunal would justify the conviction of the accused’ (ট্রাইব্যুনাল যেভাবে অভিযোগগুলোর বিচার করেছে, তাতে করে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আনীত শাস্তিগুলো যথার্থই মনে হয়)।
এরপরে সচিব কিন্তু সুপারিশ করেছিলেন ৭ নভেম্বরের নায়ক হিসাবে এবং উত্থাপিত অভিযোগগুলোর আলোকেই কর্নেল তাহেরের শাস্তি কমিয়ে দেয়া হোক। কিন্তু পরে তার এ সুপারিশ আরেকটি মিটিং করে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। ১৮ জুলাই রাষ্ট্রপতি সায়েম তাহেরের মৃত্যুদ-াদেশ বহাল রাখেন। পর দিন সংবাদপত্রে সংক্ষিপ্ত করে সংবাদটি প্রচারিত হয়। সরকারি ভাষ্যে তাও ছিল মিথ্যায় ভরা। মামলায় যা বলা হয়নি তাও মিথ্যাভাবে বলা হয় সরকারি ভাষ্যে।
তাহের সকালে পত্রিকা দেখে রেগে যান। তাঁর শেষ চিঠিতে তিনি বলেন, ‘মামলার যা বিবরণ প্রকাশ করা হয়েছে, তা সম্পূর্ণভাবে মিথ্যা। রাজসাক্ষীদের জবানবন্দীতে প্রকাশ পেয়েছে আমার নেতৃত্বেই ৭ নভেম্বর সিপাহী বিপ্লব ঘটে। আমার নির্দেশেই জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করা হয়। এড. আতাউর রহমান খান, জুলমত আলী খানসহ অন্যান্য যারা উপস্থিত ছিলেন তারা যেন এই মিথ্যা প্রচারের প্রতিবাদ করেন ও সমগ্র মামলাটির সত্য বিবরণ প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। আমি মৃত্যুকে ভয় পাই না। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক ও চক্রান্তকারী জিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আমাকে জনগণের সামনে হেয় করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে।’
অথচ ৫ বছর আগে সায়েম গুরু শাস্তি ও সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে মৃত্যুদ-ে দ-িত আসামীর অধিকারের ওপর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনগত সিদ্ধান্ত প্রদান করে জনৈক ব্যক্তির ওপর আরোপিত মৃত্যুদ-াদেশ খারিজ করে দেন। উদাহরণ সৃষ্টিতে এই সিদ্ধান্তের যে তাৎপর্য তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিরান্ডা ডিসিশনের সাথে তুলনীয়।
পূর্ণচন্দ্র ম-ল বনাম রাষ্ট্র মামলায় সায়েম বলেন, ‘একেবারে শেষমুহূর্তে বিবাদী পক্ষের উকিল নিয়োজিত হওয়ায় মামলায় সংগতভাবে সমর্থিত হবার ব্যাপারে বিবাদীর অধিকার সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়েছে। ফৌজদারি নিয়মের বিধি অনুযায়ী ফৌজদারি আদালতে আনীত একজন বিবাদীর পূর্ণ অধিকার রয়েছে একজন আইনজ্ঞের মাধ্যমে আত্মপক্ষ সমর্থন করার। ব্যক্তিগত আলাপ আলোচনার জন্য আইনজ্ঞের সাথে সাক্ষাৎ আইনজ্ঞকে তার কেস সাজাবার জন্য উপযুক্ত সময় দেয়াও এই অধিকারের অন্তর্ভুক্ত গুরু অপরাধে অভিযুক্ত। একজন অপরাধীর জন্য একেবারে শেষ মুহূর্তে একজন উকিল নিয়োগ লিগ্যাল রিমেমবের্যান্স ম্যানুয়াল (১৯৬০) এর দ্বাদশ অধ্যায়ের ষষ্ঠ অনুচ্ছেদে বর্ণিত অধিকারকে শুধুমাত্র লঙ্ঘনই কওে না, সেই সাথে এর মাধ্যমে দ্ব¬াদশ অধ্যায়ে বর্ণিত উদার সুবিধা সমূহের মূল উদ্দেশ্যকে ব্যর্থ করে দেয়া হয়। এর মাধ্যমে ফৌজদারি বিধির ৩৪০তম সেকশনে বর্ণিত অধিকার থেকেও অভিযুক্তকে বঞ্চিত করা হয়। কাজেই এ রকম একটি বিচার অনুষ্ঠান সঠিক আইনসিদ্ধ পদ্ধতিতে অনুষ্ঠিত হয়নি বলে ধরতে হবে এবং সে ক্ষেত্রে নতুন বিচারের প্রয়োজন।’
বিচারপতি সায়েম সে রকম একজন বিচারপতি, যাঁর নখদর্পণে ছিলো আইনের সব বিধি বিধানগুলো। অন্যায়ভাবে যাতে কেউ সাজাপ্রাপ্ত না হন, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ। এই নীতিবান ব্যক্তিটি ছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। তাঁর অনুমোদনের পরেই ট্রাইব্যুনালে ঘোষিত মৃতুদ-ের রায় চূড়ান্ত হবে। অথচ এর পরও তিনি মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ-ের রায় চূড়ান্ত করে দস্তখত দেন। এত দ্রুততম সময়ে এর আগে কোনো রাষ্ট্রপতি কোনো মৃত্যুদ-ের রায় চূড়ান্ত করেননি। কর্নেল তাহেরের মৃত্যুদ- অনুমোদন করে তিনি শুধু সব আইন-কানুনকে জলাঞ্জলিই দিলেন না, তাঁর নীতিবোধ আর সাহসিকতাকে বিসর্জন দিয়ে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় একগুচ্ছ সামরিক আফিসারের আক্রোশ চরিতার্থ করারও সুযোগ করে দিলেন। এ কলঙ্ক শুধু একজন নীতি বিসর্জনকারী বিচারকের নয়, এ কলঙ্ক সমগ্র জাতির। আইনের লেবাসে এ বেআইনি কর্মের কলঙ্ক ঢাকার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু এ এমন এক কলঙ্ক, যা ঢাকা যায় না। কারণ কর্নেল তাহেরকে হত্যা করা হয়েছে। খুনিরা লাশ গুম করতে পারেনি। নিহত তাহের তাঁর মর্যাদা হারাননি। তাঁর মৃত্যু খুনিদের মুখেই লেপন করে দিয়েছে কলঙ্কের কালিমা। এ কলঙ্ক মুছবার জন্য এই হত্যাকা-কে আইনি লেবাস পরানোর উদ্দেশ্যে হত্যাকা-ের ১০ দিন পর ৩১ জুলাই ৭৬ সালে আইন মন্ত্রণালয় সামরিক আইনের ২০তম সংশোধনী জারি করেন। সে ডিক্রির বিধান ছিল সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে রাজনৈতিক মতবাদের প্রচার নিষিদ্ধ ও বেআইনি এবং সে ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ-। তাই যে অপরাধে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসিতে হত্যা করা হয়, , তখন দেশে সেরূপ অপরাধের বিচার ও সাজা দেবার বিধান সামরিক আইনেও বলবৎ ছিল না।
দেশে প্রচলিত ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড এবং সিডিউল ৫ এর ৩৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো আসামির চূড়ান্ত মৃত্যুদ-াদেশ হবার পর প্রিজন সুপার ইনডেন্টকে একটা ওয়ারেন্ট (আদেশ) ইস্যু করতে হয়। জেল কোড ১৯১৯ এ বলা আছে ‘Prison Superintendent’ ওয়ারেন্ট পাবার পর ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার জন্য যে দিনটি নির্ধারণ করবেন, সেই দিনটি ওয়ারেন্ট পাবার দিন হতে ২১ দিন আগে বা ২৮ দিন পরে হতে পারবে না। অর্থাৎ ওয়ারেন্ট পাবার ২১ দিনের আগে কোনোক্রমেই মৃত্যুদ-াদেশ কার্যকর করা সম্ভব নয়। এরপরও বিচারপতি সায়েমের বিবেক যাতে জাগ্রত থাকে এবং তিনি যেন কোনো ভুল না করেন সেজন্য আইনগত দিক তুলে ধরে লন্ডন থেকে অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এর প্রধান কার্যালয় থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির কাছে একটি জরুরি আপিল করা হয় তাহেরকে ক্ষমা করার জন্য। এই জরুরি আপিলে অ্যামেনেস্টি বলেছিল, সামরিক আইনের আওতায় জেলের ভেতরে গোপনে অনুষ্ঠিত একটি বিচার জাতিসংঘ ঘোষিত সার্বজনীন মানবাধিকারের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানের পর্যায়ে পড়ে না। সর্বোচ্চ আইনগত কর্তৃপক্ষের কাছে আপিল করার অধিকারসহ ফৌজদারি আদালতে আইনের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় অভিযুক্তের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করা যেতে পারে। অ্যামেনেস্টির এই তারবার্তা ১৯৭৬ সনের ২০ জুলাই রাষ্ট্রপতি সায়েমের দপ্তরে পৌঁছায়।
কিন্তু এত কিছুর পরও তৎকালীন জিয়া-সায়েম সরকার রায় ঘোষণার মাত্র তিন দিনের মধ্যে তহেরকে ২১ জুলাই ৭৬ ভোর রাতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে।
হাসানুল হক ইনু: সভাপতি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ; মুক্তিযুদ্ধে বিএলএফ (মুজিব বাহিনী) এর প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রধান; ৭৫ এর ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের সংগঠক ও বিপ্লবী গণবাহিনীর উপপ্রধান।
সূত্র:
‘সমগ্র জাতির মধ্যে আমি প্রকাশিত’; আবু তাহেরের ৭৩তম জন্মদিন ও সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের ৩৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে কর্নেল তাহের সংসদের স্মারক প্রকাশনা। (১৪ নভেম্বর, ২০১১)।