উচ্চ আদালতে ড. আনোয়ার
কর্নেল তাহের হত্যাকা- মামলা: উচ্চ আদালতে রিট আবেদনকারী ড. মো. আনোয়ার হোসেন এর বক্তব্য
মহামান্য আদালত,
আমাকে সম্পূরক রিট বক্তব্য প্রদানের সুযোগ দেয়ার জন্য আপনাকে গভীর কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানাই।
আমার জীবনে ইতোপূর্বে আরও দুইটি আদালতের সম্মুখীন হতে হয়েছে। তার একটি হচ্ছে কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তমের সাথে সহ-অভিযুক্ত হিসেবে ১৯৭৬ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে অনুষ্ঠিত গোপন বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইবুন্যাল এবং অপরটি ২০০৮ সালে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট। প্রথমোক্ত গোপন ট্রাইব্যুনালে বিচারের নামে প্রহসন করে পরিকল্পিতভাবে কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তমকে হত্যা এবং আমিসহ মোট ১৭ জনকে বিভিন্ন মেয়াদি সাজা প্রদান করা হয়েছিল। দ্বিতীয়োক্ত কোর্টটি দেশে অঘোষিত সামরিক শাসনে এক চরম ভীতিকর পরিবেশে চলেছিল। উভয় কোর্টেই অত্যন্ত বিরূপ পরিবেশে আমি জবানবন্দি প্রদান করেছি। সিএমএম কোর্টে আমাকে ও আরও দুজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কয়েকজন ছাত্রকে দু’বছর সাজা প্রদান করা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর উচ্চতর আদালতে আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ঐ সাজা খারিজ হয়ে যায়।
মহামান্য আদালত,
উল্লি¬খিত ঐ দুইটি আদালতের সঙ্গে মহামান্য হাইকোর্টের বর্তমান এই আদালতের কতই না পার্থক্য। আজ দ্বিধাহীন চিত্তে সচেতন এই উচ্চারণ করছি যে, দেশের সর্বোচ্চ এই আদালত সত্য উচ্চারণে যে স্বাধীন-মুক্ত পরিবেশের সৃষ্টি করেছেন, সত্য উদঘাটনে যে আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, তাতে আমাদের মনে এই আশাবাদ জাগ্রত হয়েছে যে, আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ যা আমরা বহু আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে অর্জন করেছি, তা কোন বর্বর দেশ নয়; ন্যায়ের শাসন প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা এগিয়ে এসেছে এবং অতীতের বহু গুরুতর অন্যায়ের প্রতিবিধানে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সেইসব নিপীড়িত মানুষের কথা শুনছে, যারা শুধু গভীর দুঃখ ও হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে জীবন অতিবাহিত করছিলেন, যাদের কাছে কোন স্বপ্ন ছিল না। এ অবস্থায় অনেকে মৃত্যুও বরণ করেছেন। আজ নতুন আশাবাদের সৃষ্টি হয়েছে। এ যেন নিরাশার অন্ধকার থেকে আশার আলোর ভুবনে প্রবেশ। পূর্ণবার আপনাকে গভীর অভিবাদন ও ধন্যবাদ জানাই।
মহামান্য আদালত,
গত ২৩ আগষ্ট ২০১০ তারিখে আমি মো: আনোয়ার হোসেন, আমার প্রয়াত ভ্রাতা কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তম এবং অপর ভ্রাতা প্রয়াত আবু ইউসুফ, বীর বিক্রম-এর সহ-ধর্মিনীগণ আমাদের সম্মানিত আইনজীবী ড. শাহদীন মালিকের মাধ্যমে হাইকোর্টের এই মহামান্য বেঞ্চে একটি রিট আরজি পেশ করেছিলাম। আমরা অত্যন্ত কৃতজ্ঞ যে, মহামান্য বেঞ্চ আমাদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে একটি ঐতিহাসিক রুল জারি করেন। যার ফলশ্রুতিতে আমাদের রিট আবেদনের ওপর শুনানি চলছে।
মহামান্য আদালত,
ইতোমধ্যেই মহামান্য আদালত ১৯৭৬ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে অনুষ্ঠিত গোপন বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইব্যুন্যালে অভিযুক্ত যাঁরা এখনও বেঁচে আছেন, তাঁদের স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই আদালতের সামনে বক্তব্য পেশের সুযোগ করে দিয়েছেন। এ ছাড়া গোপন ট্রাইব্যুনালের একমাত্র জীবিত সদস্য ঢাকা সদর দক্ষিণের তৎকালীন প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট জনাব মো: আব্দুল আলী এবং বিচারের সাথে সম্পর্কিত সরকারি কর্মকর্তা ও উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা যারা জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের নীতি-নির্ধারণের সাথে যুক্ত ছিলেন, তাদের কোর্টে তলব করেছেন।
মেজর জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু ছাড়া সমনকৃত সকলেই মহামান্য আদালতের সামনে তাদের বক্তব্য পেশ করেছেন। ‘ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউ’ পত্রিকার দক্ষিণ-এশীয় রিপোর্টার প্রখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফৎশুলজ ১৯৭৬ সালে কর্নেল তাহের এবং সহ-অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গোপন বিচার সম্পর্কে রিপোর্ট প্রদানের জন্য ঢাকায় এসেছিলেন, কিন্তু জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার তাঁকে জোরপূর্বক বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত করেছিল এবং তিনি পরবর্তী সময়ে তাঁর অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার মাধ্যমে উল্লে¬খিত গোপন বিচার সম্পর্কে নানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যার মধ্যে কর্নেল তাহেরের ঐতিহাসিক জবানবন্দি রয়েছে তা প্রকাশ করেন। ‘Taher’s Last Testament’ নামে তা প্রথম ১৯৭৭ সালে ‘Economic and Political Weekly (Bombay)-এর বিশেষ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। এরপর পূর্ণাঙ্গ পুস্তক হিসেবে ‘Bangladesh: The Unfinished Revolution’ নামে লন্ডনের ‘Zed Press’ তা প্রকাশ করে। মহামান্য আদালত, সাংবাদিক লরেন্স লিফৎসুলজকেও তাঁর বক্তব্য প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে সত্য প্রকাশের অভূতপূর্ব এই প্রেক্ষাপটে আমার সম্পূরক রিট আরজি পেশ করছি।
মহামান্য আদালত,
আমার প্রয়াত ভ্রাতা কর্নেল আবু তাহেরের অনুপ্রেরণায় আমাদের গোটা পরিবার মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। অধস্তন সৈন্যদের চাপে পড়ে নয়, মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার আবাল্য-লালিত স্বপ্নকে বুকে ধারণ করে তিনি সুদূর পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ১১নং সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে বহু বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে কর্নেল তাহের নেতৃত্ব দেন এবং ১৯৭১-এর ১৪ নভেম্বর তারিখে ঢাকার প্রবেশদ্বার নামে খ্যাত কামালপুর শত্রু ঘাঁটি দখলের সম্মুখ যুদ্ধে তিনি গুরুতর আহত হন। তাঁর প্রণীত যুদ্ধ পরিকল্পনা অনুযায়ী ১১নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সাথে একযোগে সর্বপ্রথম ঢাকায় প্রবেশ করেছিল। যুদ্ধে পা হারিয়ে হাসপাতালে অবস্থান করায় কর্নেল তাহেরের পক্ষে ১৬ ডিসেম্বরে ঢাকা প্রবেশ সম্ভব না হলেও তাঁর পক্ষ থেকে আমার অপর ভ্রাতা আবু ইউসুফ, বীর বিক্রম পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের আগে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তানি অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজির সদর দপ্তরে আত্মসমর্পণ আলোচনার জন্য মিত্র বাহিনীর অধিনায়কদের সাথে গিয়েছিলেন। বিজয়ী মুক্তিবাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে তিনি পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজীর স্টাফ কারের পতাকাটি বিজয়ের প্রতীক হিসেবে তুলে নিয়েছিলেন, যা তাঁর সহধর্মিনী বর্তমান রিট আবেদনকারীদের একজন মিসেস ফাতিমা ইউসুফ এখনও পরম যতেœ সংরক্ষণ করছেন।
আমাদের ৭ ভাই ও ২ বোন সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। তাদের মধ্যে ৪ জন বীরত্বসূচক খেতাব লাভ করেছিলেন।
মহামান্য আদালত,
আমি ১৯৭৫ সালের পয়লা জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন বিভাগে শিক্ষকতায় যোগদান করি। সে বছরের নভেম্বরে আমার দুই ভাই যথাক্রমে কর্নেল আবু তাহের, বীর উত্তম ও আবু ইউসুফ, বীর বিক্রমকে গ্রেপ্তার করার পর আমার শিক্ষক জীবনেও ছেদ পড়ে। আমাদের গোটা পরিবার জেনারেল জিয়াউর রহমানের রুদ্র রোষের কবলে পড়ে। আমাকে আত্মগোপনে চলে যেতে হয়। ১৯৭৬ সালের ১৫ মার্চ আমাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ডিএফআই-এর (বর্তমান ডিজিএফআই) সেইফ হোল নামে পরিচিত গোপন নির্যাতন কেন্দ্রে ৩ মাস আটক রাখা হয়। ১৯৭৬-এর ১৫ জুন তারিখে আমাকে সেখান থেকে পুলিশ হেফাজতে কোর্ট হাজতে এবং সেই রাতেই ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ডিএফআই সেলে আমার বন্দী জীবনের প্রথম এই ৩ মাস কোন হিসেবের খাতায় নেই। কোর্ট হাজতে প্রেরণের দিন থেকে আমাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
কর্নেল তাহেরসহ আমাদের সহ-অভিযুক্তদের কিভাবে বিচার প্রহসনের সম্মুখীন করা হয়েছিল, কিভাবে বিচারের বাণী নিভৃতে কেঁদেছিল, তা সহ-অভিযুক্তদের বক্তব্যে মহামান্য আদালত জানতে পেরেছেন। তাই সে সম্পর্কে পুনরাবৃত্তি না করে তথাকথিত ঐ বিচার যে কার্যত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সবচেয়ে অগ্রবর্তী ধারক যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করার মধ্যদিয়ে ক্ষমতায় আসীন মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, তাদের নিশ্চিহ্ন করার নীল-নকশা ছাড়া আর অন্য কিছু ছিল না, সে সম্পর্কে বলবো। এই নীল-নকশা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জেনারেল জিয়া যে বিচারের নামে প্রহসন করে অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় কর্নেল তাহেরকে হত্যা করেছিলেন, সে সম্পর্কেও জানাবো। এই হত্যাকা- অনুষ্ঠানে জিয়াউর রহমানের সহযোগী যাদের কথা ইতোমধ্যেই উচ্চারিত হয়েছে, তাদের বাইরেও আরও যারা জড়িত ছিলেন, তাদের সম্পর্কে বলবো।
মহামান্য আদালত,
যে ৩৩ জনকে গোপন বিচারের সম্মুখীন করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে ২ জন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার, প্রায় সকলেই প্রখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সারির সংগঠক ছিলেন। সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক রাজনীতিবিদ, সেনানায়ক, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ ও প্রজ্ঞাবান মানুষ ছিলেন অভিযুক্তরা। আর যে বিশেষ সামরিক আইন ট্রাইব্যুনালটি জিয়াউর রহমান গঠন করেছিলেন, তার চেয়ারম্যান নিযুক্ত করেছিলেন কর্নেল ইউসুফ হায়দারকে, যিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ঢাকায় অবস্থান করেও মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের পরিবর্তে পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। ট্রাইব্যুনালের বাকি ৪ জন সদস্য কেউই মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেননি। লক্ষণীয় যে গোপন এই সামরিক আইন ট্রাইব্যুনালের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য অর্থাৎ ৫ জনের মধ্যে ৩ জনকে রাখা হয় প্রতিরক্ষা বাহিনী থেকে। যে দু’জন বেসামরিক ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়োগ দেয়া হয় তাদেরকেও নেয়া হয় প্রশাসনিক বিভাগ থেকে, বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেসি থেকে নয়। সরকার পক্ষের প্রসিকিউটর ছিলেন জনাব এ টি এম আফজাল, যাকে তাহেরের ফাঁসির পর হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগ করেন জিয়াউর রহমান এবং পরবর্তীকালে তিনি দেশের প্রধান বিচারপতিও হন। মামলার সাক্ষ্য পরিচালনা করেন সে সময়কার স্পেশাল পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুর রেজ্জাক খান। সরকার পক্ষের এই দুই আইনজীবীকে সহযোগিতা করেন তৎকালীন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী আব্দুল ওহাব।
দেশের বিদ্যমান আইনের গুরুতর লঙ্ঘন হয় এমন বহু পদেক্ষেপ নেয় জিয়া সরকার। বিচারে ন্যূনতম নিরপেক্ষতা রক্ষার জন্য ট্রাইব্যুনালে বিচার বিভাগ থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য নেয়া উচিত হলেও কাউকে নেয়া হয়নি। ট্রাইব্যুনালকে প্রদত্ত ক্ষমতার পরিধিও ছিল ব্যাপক। সাধারণ আইন, সশস্ত্র বাহিনী এবং সামরিক আইনের বিরুদ্ধে অপরাধ এমন সব সামরিক-বেসামরিক অপরাধের বিরুদ্ধে বিচারের ক্ষমতা পায় ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনাল গঠনের সামরিক অধ্যাদেশ ১৪ জুন জারি হলেও ঐ একই দিনে ট্রাইব্যুনালের সদস্যরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শন করেন। তারও পূর্বে ১২ জুন তারিখ থেকে উপর মহলের নির্দেশে ডি আই জি প্রিজনের অফিস কক্ষটি খালি করে গোপন আদালত কক্ষ হিসেবে তৈরি করা হচ্ছিল। এসব থেকে স্পষ্ট হয়ে যায় যে অধ্যাদেশ জারির পূর্বেই ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে এবং তথাকথিত এই বিচার ছিল পূর্বপরিকল্পিত সাজানো মহড়া। আমাদের দ- ছিল পূর্ব নির্ধারিত। কারাগারের অভ্যন্তরে অস্ত্রধারী প্রহরী থাকতে পারে না। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে ঘটেছিল তার ব্যতিক্রম। জিয়াউর রহমান কর্তৃক সে সময় নবগঠিত সশস্ত্র আর্মড ব্যাটালিয়ান কারাভ্যন্তরে আনা হয় আমাদের পাহারা দেবার জন্য। এ ছাড়া কারাগারে এবং কারাগারের বাইরে ঘনবসতিপূর্ণ ঐ এলাকার বিভিন্ন বাড়ির ছাদে মেশিনগান পোস্ট বসানো হয়। এমনকি কারাভ্যন্তরে আমাদের আদালত কক্ষের দরজা-জানালার বাইরে হালকা মেশিনগানের পাহারা বসানো হয়। এ সবই ছিল বেআইনী। ট্রাইব্যুনালকে আমাদের আইনজীবীরা বারবার তা স্মরণ করিয়ে দিলেও তারা ছিলেন নির্বিকার।
মহামান্য আদালত,
১৯৭৬ সালের মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত ডিএফআই সেলে আমার বন্দিত্বকালে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে ডিএফআই এবং আরও কয়েকটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা গোপন মামলা সাজানো ও কর্নেল আবু তাহেরকে মেরে ফেলার চক্রান্ত চূড়ান্ত করে ফেলে। সে সব তৎপরতা আমিও আঁচ করতে পারি। ডিএফআই সেল থেকে চোখ বাঁধা অবস্থায় পুলিশি হেফাজতে প্রেরণের প্রাক্কালে কোন একজন আমাকে চুপিসারে কানে কানে বলেছিলেন, আপনাদের সামনে কঠিন বিপদ। সে বিপদ যে কত ভয়াবহ, তা বুঝেছিলাম গোপন বিচার ও তাহেরের ফাঁসির ঘটনায়। তৎকালীন ডিএফআই প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল আমিনুল ইসলাম, ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইন্টলিজেন্স (এনএসআই)-এর প্রধান এবিএস সফদার, স্বরাষ্ট্র সচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ, এবং সংস্থাপন সচিব আব্দুর রহিম ছিলেন তাহের হত্যা চক্রান্তে জিয়াউর রহমানের প্রধান সহচর। উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তারা তো ছিলেনই।
সফদার, সালাউদিন এবং রহিম ছিলেন আয়ুব সরকারের জেষ্ঠ্যতম বাংগালী গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা কর্মকর্তা। আগরতলা মামলায় সরকার পক্ষকে সব কাগজ-পত্র সরবরাহ করেছিলেন এবিএস সফদার। বস্তুত সামরিক প্রসিকিউটরের ব্রিফকেস বহনকারী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এবিএস সফদার এবং আব্দুর রহিম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘Office of Public Safety (OPS)’ প্রোগ্রামে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন। বিদেশে অবস্থানরত বহু বাঙালি কর্মকর্তারা যেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, সেখানে এই দুই কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ শেষ করে ১৯৭১-এর জুন মাসে অবরুদ্ধ পূর্ব পাকিস্তানে এসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সঙ্গে পূর্ণ সহযোগিতা করেন। এসময় রাজাকার বাহিনীর অন্যতম সংগঠক ছিলেন আব্দুর রহিম। বঙ্গবন্ধু হত্যাকা-ের পরপরই এবিএস সফদারকে এনএসআই-এর প্রধান করা হয়। আব্দুর রহিম হন খুনি মোশতাকের অন্যতম পরামর্শদাতা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা কর্মকর্তা হিসেবে দীর্ঘসময় দায়িত্বপালনকারী জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধী এইসব দালালদের যোগসাজশে দেশের প্রথমসারির মুক্তিযোদ্ধাদের সমূলে বিনাশ করার চক্রান্তের ফসল হচ্ছে কর্নেল তাহের ও তাঁর সহযোগীদের বিরুদ্ধে গোপন সামরিক আইন ট্রাইব্যুনাল।
পূর্ব-পরিকল্পিত তাহের হত্যা সম্পর্কে জেনারেল জিয়ার অন্যতম সহচর এবং বর্তমান বিএনপির শীর্ষনেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ তাঁর ‘Democracy and the Challenge of Development: A study of Political and Military Interventions in Bangladesh’ গ্রন্থে উল্লে¬খ করেন, “Why did Zia allow Taher to be hanged, the person who freed him from captivity?—— the officers who had not taken part in the liberation war, had found a new ally in Zia after the killing of Mujib and removal of Moshtaque. They needed each other in order to survive both as a class and a force in the civil-military structure of the country. When it came to the sentencing of Taher, the repatriated officers wanted him hanged – out of forty-six senior army officers summoned by Zia to discuss the issue; all were in favor of this ultimate and final form of punishment.”
(পৃষ্ঠা ২৯-৩০)। ফুটনোটে ব্যারিস্টার মওদুদ লিখেছেন, “This was disclosed to the author by Zia himself.”
মহামান্য আদালত,
ভেবে দেখুন আইনের কি গুরুতর লঙ্ঘন জেনারেল জিয়াউর রহমান করেছিলেন। তার সৃষ্ট তথাকথিত গোপন সামরিক আইন ট্রাইব্যুনালেও নয়, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সদর দপ্তরে ঊর্ধ্বতন সামরিক অফিসার যাদের অধিকাংশ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি, তাদের মিটিংয়ে তাহেরের মৃত্যুদ- স্থির হয়েছিল। নির্ধারিত হয়েছিল অন্যান্য সহ-অভিযুক্তদের বিভিন্ন মেয়াদি দ-।
মহামান্য আদালত,
তাই আজ দিবালোকের মত সত্য হয়ে উঠেছে, বিচারের নামে প্রহসন করে জিয়াউর রহমান এবং তার সহযোগীরা কর্নেল তাহেরকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছেন। এ বিষয়ে তৎকালীন সময়ে ঢাকার ডিসি ড. এ এম এম শওকত আলী গত ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১০ তারিখে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় “সামরিক আদালতে বিচার: কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের সংরক্ষিত নথি” প্রবন্ধে বলেন, “তখন দেশে ছিল সামরিক শাসন। তৎকালীন সেনাপ্রধান কর্তৃক গঠিত একটি সামরিক আদালত অতি সংক্ষিপ্তভাবে বিচার কাজ সম্পাদন করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। একে বিচার বহির্ভূত হত্যা বলা যায় কিনা, সে বিষয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করা অমূলক। কারণ সংবিধান সম্মতভাবে প্রতিষ্ঠিত আদালতের বাইরে যদি কারও দ- কার্যকর হয়, তবে এ ধরনের ঘটনা বিচার বহির্ভূত হত্যার ঘটনা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।”
তাহের তাঁর ঐতিহাসিক জবানবন্দিতে বলেছিলেন, “A law is not a law unless it is a good law aiming at the good of the people and the good of the country. The ordinance promulgated on 14th June 1976 is a black law. It was promulgated merely to suit the designs of the government. The ordinance is illegal. So this tribunal ceases to have any right legally or morally to try me.”
তিনি আরও বলেন, “The action of this tribunal has put to shame what good things human civilization has achieved through constant endeavor from the beginning of time until today.”
জবানবন্দি শেষ করেন তিনি এই বলে, “I am not afraid. I love my country and my people. I am part of the soul of this nation. No one dare separate us. There is no greater asset in life them the possession of a fearless mind. And I have that. I offer a call to my nation to acquire the same determination.”
ফাঁসির মঞ্চে কর্নেল তাহের উচ্চারণ করেছিলেন, “সব কালো আইন ভাঙ্গতে হবে বার্তা পেলাম, চৈতীর শেষে ঝড়ো বৈশাখে তাই জন্ম নিলাম। পাপী আর পাপ থেকে দূরে থাকবো, তাই হাতে অস্ত্র নিলাম। ইতিহাস বলবেই শোষকের মৃত্যুকবজ আমিই ছিলাম। পৃথিবী, অবশেষে এবারের মত বিদায় নিলাম।”
মহামান্য আদালত,
সত্য উদঘাটিত হবে কালো আইনের বেড়াজাল ভেঙ্গে। আমরা সুবিচার পাবো। যথাযোগ্য মর্যাদায় এবং মহিমায় কর্নেল তাহের এবং সহ-অভিযুক্তরা ইতিহাসে জায়গা পাবেন এবং একই সঙ্গে চক্রান্তকারী শক্তি চিহ্নিত হবে এবং তাদের অন্যায় কর্মও ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে-এই আশাবাদ ব্যক্ত করে আমার সম্পূরক রিট বক্তব্য শেষ করছি। ধন্যবাদ মহামান্য আদালত।
সূত্র:
‘মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানে কর্নেল তাহের’; ড. মো. আনোয়ার হোসেন। আগামী প্রকাশনী, বাংলাবাজার, ঢাকা। ফেব্রুয়ারি, ২০১২।