৭ই নভেম্বর: জিয়া ও কর্নেল তাহের
সাতই নভেম্বর: জেনারেল জিয়া ও কর্নেল তাহের
নির্মল সেন
আজ ৭ নভেম্বর বিএনপির নেতৃত্বে চার দল জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে পালন করছে। এই বিপ্লব দিবস পালন সম্পর্কে আমার সংশয় এবং বিভ্রান্তি কোনোদিন কাটেনি। এই জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি শব্দগুলো বরাবরই আমার কাছে অবোধ্য, অন্তত ৭ নভেম্বরের প্রেক্ষিতে। ৭ নভেম্বর সম্পর্কে এক মার্কিন সাংবাদিকের একটি বই পড়েছি। বইয়ের নাম ‘অসমাপ্ত বিপ্লব’। এ ছাড়াও ৭ নভেম্বর সম্পর্কে অনেক লেখা পড়েছি দেশ-বিদেশে। সব লেখায়ই বলা হয়েছে ৭ নভেম্বরকে কেন্দ্র করে ঘটনার মূল নায়ক কর্নেল তাহের। মূল শক্তি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। ইতিহাসের কোথাও জাতীয় বিপ্লব বা সংহতি দিবসের খোঁজ পাইনি। এ সময়কার অন্যতম প্রধান নেতা নিঃসন্দেহে জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাঁর ভূমিকাও বিতর্কিত। তিনি ক্ষমতায় থাকাকালে এ দিবসটিকে জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ দিবসটিকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মনে হচ্ছে তাঁর উত্তরাধিকারী বিএনপি নেতৃত্বে আজকের চার দলও সে কাজটিই করবে।
তবে এখানেও একটা বিভ্রান্তি আছে। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বরে বিএনপি বলে কোনো দল জন্মগ্রহণ করেনি। মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী তখনও নিষিদ্ধ। আজকের জাতীয় পার্টির নেতা জেনারেল এরশাদ তখন পদোন্নতি পেয়ে সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার হয়েছেন। আর ইসলামী ঐক্য জোটের শায়খুল হাদিসরা তখন রাজনীতির অঙ্গনে ছিলেন না। ১৯৭৫ সালের ২৫ বছর পর দেখছি সবাই ৭ নভেম্বর পালনে একেবারে এক জোট। এরা এই দিবসটি পালনে এক জোট হলেন, একমত হলেন কীভাবে তার ব্যাখ্যা কিন্তু কোনো দিনই প্রকাশ্যে আসেনি। আমি যতটুকু লেখাপড়া করেছি তাতে আমার ধারণা, বিপ্লবের কতকগুলো লক্ষণ থাকে। বিপ্লব তো পরিবর্তন। আর এ কথাও সত্য যে, জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এ দেশের সংবিধান থেকে শুরু করে অনেক মৌলিক বিষয়েরই পরিবর্তন এনেছেন। এ পরিবর্তন সূচিত হয়েছে তাঁর ৭ নভেম্বরের ক্ষমতা দখলের পর থেকে। তাহলে কি বিএনপির বাইরের তিনটি দল ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সম্পর্কে একই ধারণা পোষণ করে। নাকি আজকে ক্ষমতার সংগ্রামে এক প্লাটফরমে এসে ৭ নভেম্বর বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালনে একমত হয়েছে। এ মুহূর্তে এ কথা লেখার মতো ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু ৭ নভেম্বর পালন নিয়ে আপনারা যে কেরামতি দেখাচ্ছেন, তাতে মনে হয় দিবস-টিবস পালন আদৌ মুখ্যও কোনো কথা নয়; নির্বাচন সামনে রেখে নিজেদের শক্তির মহড়া দেয়াই আপনাদের এ কর্মসূচির একমাত্র লক্ষ্য। আর সেখানেও আপনারা খাবি খাচ্ছেন প্রতি মুহূর্তে। একটা সমাবেশের স্থান নির্ধারণ নিয়ে আপনারা একমত হতে পারছেন না। আপনাদের নেত্রী অসুস্থ সে কথাও সকলে বিশ্বাস করছে না। সব কিছুই হ-য-ব-র-ল হয়ে গেছে। এর আগে পত্রিকান্তরে আমি আশঙ্কা প্রকাশ করেছি যে, আপনারা হয়ত ৭ তারিখে হরতাল দিয়ে দেবেন। মানুষের ভোগান্তি হবে। আপনারা ভাববেন একটা তো কিছু করা হলো। তবে এ নিয়ে দুঃখ করার কিছুই নেই। পাঁচ ঘরানার সাতজনকে ডেকে ঐক্য করতে গেলে এ ঘটনাই ঘটে। আপনারও তাই ঘটাচ্ছেন।
তা হলে ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর কী ঘটেছিল? ১৫ আগস্ট সপরিবারে রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হয়েছিলেন। ক্ষমতায় এসেছিল খন্দকার মোশতাক। অবসর নিতে হয়েছিল প্রধান সেনাপতি জেনারেল শফিউল্লাহকে। নতুন প্রধান সেনাপতি হলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। সেনাবাহিনীতে টু শব্দটি শুনলাম না। মনে হলো একজনের যাওয়া ও অপর জনের আসাও এ ঘটনার পিছনে কাজ করেছে। শুধু দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্রে প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হননি। এর পেছনে নিশ্চয়ই সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব এবং কর্তৃত্বের দ্বন্দ্ব ছিল। নইলে ঐ হত্যাকা-ের পর পরই এ ঘটনা ঘটত না।
তখন প্রতিদিনই ঘটনা ঘটত। মাথামু-ু কিছুই বুঝতাম না। অক্টোবরের শেষ দিকে শুনলাম ক্যান্টনমেন্ট গরম। যে কোনো দিন যে কোনো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কাকার অসুখ। বাড়ি চলে গেলাম। নভেম্বরের দু-তিন তারিখ হঠাৎ একদিন ঢাকা বেতার বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ি থেকে ছুটলাম ঢাকার দিকে। বরিশাল লঞ্চে এসে দেখলাম মাত্র আমার মতো কয়েক যাত্রী। প্রকৃতপক্ষে লঞ্চ যাত্রীশূন্য। ঢাকায় পৌঁছে শুনলাম জেলখানায় চার নেতা নিহত হয়েছে। প্রেসক্লাবে ঢুকলাম। বললাম চলো চার নেতার লাশ দেখতে যাব। অন্তত স্বাধীনবাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের বাড়িতে আমাকে যেতেই হবে। কেউ রাজি হচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত রাজি হলো ফটোগ্রাফার মানু মুন্সী। তার হোন্ডায় চড়ে তাজউদ্দিন সাহেবের বাসায় গেলাম। তাঁর লাশ দেখারও সুযোগ হলো না। লাশ চলে গেছে দেশের বাড়িতে। ঢাকায় তাঁর কবরও হলো না।
এবার খবরের কাগজে ভিন্ন খবর দেখলাম। এ বিস্তারিত খবর বাড়ি বসে পাইনি। নভেম্বরের ২ তারিখে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ সেনাবাহিনীতে চেন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটান। বঙ্গভবন ঘেরাও করেন। মন্ত্রীদের পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। সেনাবাহিনীর নাকি অভিযোগ যে, কয়েক মেজর বঙ্গভবনে বসে দেশ চালাচ্ছে। এরাই হত্যাকা- ঘটিয়েছে ১৫ আগস্ট। এদের সাথে মূল সেনবাহিনীর কোনো সম্পর্ক নেই। এদের নেতৃত্ব বৈধ নয়। তাই সেনাবাহিনীকেই ক্ষমতায় যেতে হবে।
এই ভাল ভাল কথা পত্রিকায় পড়লাম। খালেদ মোশাররফের কথাও শুলাম। কিন্তু ছবিতে দেখলাম ভিন্ন চিত্র। বাংলাদেশ টাইমসে খালেদ মোশাররফের ছবি ছাপা হলো। তিনি প্রধান সেনাপতি হয়েছেন। অপর দুই সেনাপ্রধান তাঁকে ব্যাজ পরিয়ে দিচ্ছেন। অর্থাৎ সামরিক বাহিনীতে এক প্রধানের পরিবর্তে আরেক প্রধান আসছে। খন্দকার মোশতাকদের কোনো বিচার হচ্ছে না। এমনকি তিনি জেলখানায় চার নেতার ঘাতকদের নিরাপদে বাইরে যেতে দিচ্ছেন। আমার মনে হলো এটা এক অভ্যুত্থানের পরিবর্তে আরেক অভ্যুত্থান। খালেদ মোশাররফকে তাঁর কাজ করার আগেই প্রধান সেনাপতি জিয়াকে গৃহবন্দি করা হলো। এক দলের ভাষ্য হচ্ছে, প্রধান সেনাপতিকে গৃহবন্দি করে তো চেন অব কামন্ড ফিরিয়ে আনা যায় না। অপর পক্ষের ভাষ্য হচ্ছে, বিপথগামী মেজরদের সহযোগিতায় তিনি সেনাপতি হয়েছিলেন। সুতরাং তিনি তাদের বিরুদ্ধে যাবেন না। চেন অব কমান্ড ফিরাতে হলে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ হচ্ছে ৫ নভেম্বরের কথা। ৬ নভেম্বর প্রেসক্লাবে জাসদের এক সাংবাদিকের সাথে দেখা হলো। সে বলল আজ রাত বারোটার সময় আপনি গুলির শব্দ শুনতে পাবেন। তার পর কী হবে পরে বুঝতে পারবেন। সত্যি সত্যি পরবর্তীকালে সব বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু কোনোদিনই এ ব্যাপারে একমত হইনি। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদ ১৯৭৩ সালে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করে। এরা একটি পিপল মিলিশিয়া গঠনের লক্ষ্যে কাজ করে যেতে থাকল। তাদের বক্তব্য ছিল স্বাধীন দেশে ব্রিটিশ বা পাকিস্তানি ধাঁচে সেনাবাহিনী কেন থাকবে। আগের সব ধারা পাল্টাতে হবে। এর নেতৃত্বে ছিলেন কর্নেল তাহের (যার কথা লিখতে হলে অনেক কিছুই লিখতে হবে)। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার বক্তব্য হচ্ছেÑ১৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর সেনাবাহিনীতে নেতৃত্বের লড়াই শুরু হয়েছে। এতে রক্তপাত হবে। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হবে। সুতরাং তারা বিদ্রোহীর ভূমিকা পালন করবে। দেশে একটি স্থায়ী শান্তি স্থাপনের জন্য একটি সর্বদলীয় সরকার গঠিত হবে। রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে। স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনায় দেশকে গড়তে হবে। এদের সেই বিদ্রোহ শুরু হবার কথা ছিল ৬ নভেম্বর রাত ১২টায়। ১২টায় সঙ্কেত দেয়ার পরেই বিদ্রোহ শুরু হবে। কিন্তু নির্ধারিত নেতা গ্রেফতার হয়ে যাওয়ায় ঐ সঙ্কেত দানের সময় পিছিয়ে যায়। তখন ৬ নভেম্বর রাত ১২টার পর ৭ নভেম্বর শুরু হয়। আমরা ৭ নভেম্বর রাত তিনটায় এক ঘোষণা শুনলাম বেতারে। ঘোষণায় বলা হলো, আজ মধ্যরাত থেকে সারা দেশে সিপাহী-জনতার অভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও বিপ্লবী গণবাহিনী ও ছাত্র, যুবক-শ্রমিক সম্মিলিতভাবে দেশে ষড়যন্ত্রকারীদের রুখে বিপ্লবী অভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের সকল সেনানিবাসের সৈন্য, বিডিআর, পুলিশ, ছাত্র-জনতা এবং সকল স্তরের মেহনতি মানুষের প্রতি আমাদের আহ্বান-প্রত্যেকে স্ব স্ব এলাকায় শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা করুন। এবং নিকটস্থ গণবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করুন।
গভীর রাতের এ ঘোষণা আমাকে চমকে দিল। ভাবলাম গণবিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি সেনানিবাসে বিদ্রোহ করে কোনো কিছু করা যাবে কি! এর সাথে শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থান ঘটলে হয়ত পরিস্থিতি সামাল দেয়া যেত। কিন্তু প্রতিপক্ষ এবং বিশেষ করে আন্তর্জাতিক শক্তি এ বিদ্রোহ মেনে নেবে না। তবে এ ধরনের কথা ভাবা ছাড়া তখন আমার আর কিছু করার ছিল না। সকালে প্রেসক্লাবে এলাম। নানা কথা শুনতে থাকলাম। শুনলাম খালেদ মোশাররফ নাকি ভারত সরকারের ছত্রীসেনা চেয়েছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী রাজি হননি। এ ধরনের গুজব তখন সর্বত্র। যে কোনো মুহূর্তে ভারতীয় বাহিনী হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিছ্ক্ষুণ পরে দেখলাম ট্রাকে ট্রাকে খন্দকার মোশতাকের ছবি। আমার সেই সাংবাদিক বন্ধুর সাথে প্রেসক্লাবে দেখা হলো। সে বলল বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করেছে। তিনি কর্নেল তাহেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছেন, তুমি আমাকে বাঁচিয়েছ, তোমার কথামতো চলব। তোমাকে ধন্যবাদ। আমার সাংবাদিক বন্ধু আরও বলল যে, জিয়াউর রহমান শহীদ মিনারে আসবেন। সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দেয়া হবে। সর্বদলীয় সরকার গঠন করা হবে। আমি আমার সাংবাদিক বন্ধুর সরলতায় মুগ্ধ এবং বিস্মিত হলাম। বললাম জিয়াউর রহমান শহীদ মিনারে আসবেন না। সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দেয়া হবে না। কোনো সর্বদলীয় সরকার গঠিত হবে না। তোমারা এখন কোনো সভা-সমাবেশ করতে গেলে গুলি খাবে।
আমি গণক নই, বা বিরাট বোদ্ধা নই। তবুও এটুকু বুঝি যে, কোনো রাজনীতিকই তাঁর শ্রেণীচরিত্রের বাইরে যায় না। জিয়াউর রহমান রাজনীতি করার জন্যই প্রধান সেনাপতি হয়েছিলেন। তিনি মুক্ত হয়ে যত ভাল কথাই বলুন না কেন, তিনি তাঁর শ্রেণীর গ-ির বাইরে যাবেন না। এবং তিনি তাই-ই করেছেন। তিনি বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফায় স্বাক্ষর করেছিলেন। কিন্তু বেতার-টেলিভিশনে বা সংবাদপত্রে ছাপা হতে দেননি। তিনি বার বারই কর্নেল তাহেরকে বলেছেন আমি আপনাদের সব কথাই শুনব; তবে আমি রাজনীতিক নই-আপনাদের সাথে এক মঞ্চে আমি বক্তৃতা দেব না। এমনকি কর্নেল তাহেরের সাথে জিয়ার আলোচনার সময় অনেক সেনা নেতাকে বলতে শোনা গেছে, জেনারেল জিয়া যেন জাসদের ফাঁদে না পড়েন। এবং সে ভূমিকাই তিনি অবলম্বন করেছিলেন।
এর পরে একের পর এক ঘটনা ঘটতে থাকল। সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খালেদ মোশাররফ, কর্নেল হুদা ও কর্নেল হায়দার নিহত হয়েছে। তাহেরের হস্তক্ষেপে খোন্দকার মোশতাক নতুন করে প্রেসিডেন্ট হতে পারলেন না। জেনারেল জিয়া প্রধান সেনাপতি থেকে গেছেন। হয়েছেন উপসামরিক প্রশাসক। তাহেরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেছে। তাহের প্রায় একঘরে।
তবে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ৭ নভেম্বরের ঘটনার নায়ক জাসদ গণবাহিনী এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। ঐ নাটকে আর সবাই খলনায়ক। এবং সেই ভূমিকা নিয়েই জেনারেল জিয়াউর রহমানকে কে বাঁচিয়েছিল। কারা বাঁচিয়েছিল। খালেদ মোশাররফের হাতে বন্দী জিয়াউর রহমান নিশ্চয়ই তাদের তথাকথিত বিপ্লবের নেতৃত্ব দেননি। যতটুকু করার তা করা হয়েছিল কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে। এর পরের ঘটনা বড় ভয়াবহ এবং বীভৎস।
একদিন দুপুরে আমার বাসায় একটি গাড়ি এলো। এক সাংবাদিক বন্ধু এলেন। তিনি বললেন, কর্নেল তাহের আপনাকে ডেকেছেন। আমি কর্নেল তাহেরের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় গেলাম। আমার সাথে অনেক কথা হলো। তিনি বললেন তাঁর বিচিত্র জীবন এবং অভিজ্ঞতার কথা। সেনাজীবন থেকে তিনি কিভাবে বিপ্লবী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের জন্য কর্নেল পাটোয়ারী, কর্নেল জিয়াউদ্দিন, কর্নেল মঞ্জুরের সাথে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছেন। কী করে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে সেক্টর কমান্ডার হয়েছিলেন; এবং বলেছিলেন কোনো সেক্টর কমান্ডারের সদর দফতর ভিন দেশে থাকতে পারবে না। সামনাসামনি যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশে যেতে হবে। এবং সামনাসামনি যুদ্ধ করতে গিয়েই তিনি তাঁর পা হারিয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তিনি ভেবেছেন, এখন তো সেনাবাহিনী হবে সাধারণ মানুষের। মেজর থেকে মেজর জেনারেল কোনো তফাত থাকবে না। সবাইকে মিলেমিশে মাঠে-ময়দানে কাজ করতে হবে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাঁর সাথে একমত হতে পারেনি। কর্নেল তাহের সেনাবাহিনী ছেড়ে এসেছেন। ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি গড়ে তুলেছেন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। এবং তাঁরই নির্দেশে এই সৈনিক সংস্থা ৭ নভেম্বর দেশকে রক্তপাত ও বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত করার জন্য বিদ্রোহ করেছিল। এ কথা বলতে তাহের কখনও থামেননি।
আমি তাঁর কথা তন্ময় হয়ে শুনছিলাম। আমি বললাম কর্নেল সাহেব আপনাকে তো গ্রেফতার করা হবে। আমি আপনার বাড়ির বাইরে অসংখ্য সামরিক ও বেসামরিক গোয়েন্দা দেখে এলাম। কর্নেল তাহেরের চোখ জ্বলে উঠল। তিনি ইংরেজিতে বললেন, জিয়া আমাকে স্পর্শ করার সাহস পাবে না। আমাকে স্পর্শ করলে প্রতিটি সেনানিবাসে বিদ্রোহ হবে। এবং বললেন, নির্মল সেন আমি ভারতের দালাল নই। আপনাদের মিথ্যাচার বন্ধ করুন। আপনি আমাকে একদিন মনে করবেন। কারণ আমি সেনাবাহিনীতে শ্রেণীসংগ্রাম চালু করেছি। তিনি একটি কথা উল্লেখ করলেন যে, জিয়ার কোনো খবর পাচ্ছি না। জিয়া কখনও আমার ফোন ধরছে না।
১৯৭৫ সালের ২৪ নভেম্বর জেনারেল জিয়ার সরকার কর্নেল তাহেরকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীকালে গ্রেফতার হন মেজর জলিল, আ স ম আব্দুর রব, হাসানুল হক ইনু, ড. আখলাকুর রহমান প্রমুখ জাসদ নেতা। তাঁদের গ্রেফতারের ৭ মাস পর এবং সামরিক শাসন জারির ১০ মাস পর রাষ্ট্রপতি সায়েম একটি অধ্যাদেশ জারি করে তাহের বা অন্যদের বিচারের জন্য বিশেষ সামরিক আদালত গঠিত হয়। সাধারণ সামরিক আইন আদালতে বিচার বিভাগ থেকে বিচারক নেয়া হয়, কিন্তু এই সামরিক আইন আদালতে বিচার বিভাগ থেকে কোনো বিচারক নেয়া হয়নি। ৫ বিচারকের মধ্যে ৩ জন ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা, দুজন ছিলেন তৎকালীন সামরিক প্রশাসনের ম্যজিস্ট্রেট।
তাহের ও অন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগে বলা হয়Ñকর্নেল তাহেরসহ অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গ ১৯৭৩ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত আইনত প্রতিষ্ঠিত সরকারকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উৎখাত করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনীর অভ্যন্তরে বিভিন্ন তৎপরতা চালায় (উল্লেখ্য, জেনারেল জিয়াও একশ্রেণীর অভ্যুত্থানকারীর সহায়তায় ক্ষমতায় এসেছিলেন)। আদালতে সাতজন রাজসাক্ষী হাজির করা হয়। তারা এক সময় সহ-অভিযুক্ত ছিল। নিরপেক্ষ কোনো সাক্ষী এ মামলায় ছিল না। সরকার পক্ষ সরকার উৎখাতের কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আদালতে দিতে পারেনি। এমনকি সরকারি উকিল মৃত্যুদ- দাবি না করলেও আদালত তাহেরকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করে। এমনকি যে আইনে তাঁর বিচার হয়েছে, সে আইনেও মৃত্যুদ-ের বিধান ছিল না। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ১৭ জুলাই আদালতের রায় অনুমোদনের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়। তিনি ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই এ রায় অনুমোদন করে। অথচ ১৯১৯ সালের জেল কোড অনুযায়ী কোনো আসামির মৃত্যুদ- কার্যকর করতে হলে ২১ দিন পূর্বে জেল সুপারেন্টেনডেন্টকে ওয়ারেন্ট পাঠাবার বিধান আছে। কিন্তু তাহেরের সবচেয়ে ভয়াবহ এবং অমানবিক হচ্ছে, যে আইনে তাহেরকে মৃত্যুদ-ে দ-িত করা হয়েছে, দ-দানকালে সে আইনের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। ২১ জুলাই তাহেরের মৃত্যুদ- কার্যকর করার পর ৩১ জুলাই আইন মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে সামরিক আইনের ২০তম সংশোধনী জারি করে। এই সংশোধনীতে সামরিক বাহিনীতে রাজনৈতিক মতবাদ প্রচারের শাস্তি মৃত্যুদ-ের বিধান প্রবর্তন করা হয়।
আমি জানি না এ ঘটনা দেশবাসীর কতজনের জানা আছে। মুক্তিযুদ্ধের এই অকুতোভয় সেনাকে যেভাবে কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে ফাঁসি দেয়া হয়েছে, তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। আজ সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য অনেক কিছু লিখছেন। লিখছেন চট্টগ্রাম বিদ্রোহের নামে মুক্তিয্দ্ধুাদের হত্যার কথা। কিন্তু তাদের সম্পর্কে টু শব্দটি করছেন না। সেনাবাহিনীর সবাই জানেন যে, কোনো বৈধ আইন ব্যতীত কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। এ অবৈধ কাজ যাঁরা করেছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াই তো শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকের একমাত্র দায়িত্ব এবং কর্তব্য। আজকে এজন্য যারা দায়ী তারা অনেকেই জীবিত নয়। কিন্তু কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে যে মিথ্যাচার করা হয়েছে, তাঁর বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে। এবং এজন্য প্রয়োজন নতুন করে বিচার এবং দাবি ওঠা উচিতÑতাহের হত্যার বিচার করতে হবে। কারণ যে আইনের অস্তিত্ব করেছে, তাদের কেন বিচার হবে না কেন!
আজ যারা বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন করছেন, তাদের কাছে আমার জানার বাসনাÑ৭ নভেম্বরের বিপ্লবের নায়ক কে? জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করেছিল কে? তাহেরকে বেআইনিভাবে হত্যা করেছে কে? আমি আশা করব ৭ নভেম্বর পালন উপলক্ষে আগে সংশ্লিষ্ট মহল আমার এ প্রশ্নের জবাব দেবে। ১৯৭৫ সালের পর ২৫ বছর কেটে গেছে। ২০০০ সালে নিশ্চয়ই এ দেশের মানুষ জানতে চাইতে পারেÑকর্নেল তাহেরকে এভাবে জীবন দিতে হলো কেন! কারা এজন্য দায়ী?