৭ নভেম্বর ও কর্নেল তাহের
৭ নভেম্বর এবং কর্নেল তাহের
ড. মো. আনোয়ার হোসেন
ব্যাপক আত্মত্যাগ, রক্তদান, সম্ভ্রমহানি, সম্পদহানির মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারীর সামরিক চড়ে বসে যখন মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে, ‘তখন তাতে বঙ্গবন্ধুর কথা থাকে না, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কথা থাকে না, থাকে না ৬ দফা বা ১১ দফার কথা, থাকে না গ্রাম-বাংলার লুঙ্গিপরা হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার কথা। এই সব কিছু ধামাচাপা দিয়ে তারা বয়ান করে এক আশ্চর্য মুক্তিযুদ্ধের কথা। যেন স্বাধীনতা এক লাল টুকটুকে আপেল, আকাশ থেকে বোঁটা ছিড়ে পড়েছে তাদের সামনে হঠাৎ করেই। যেন তার কোনো অতীত ছিল না।
ঠিক একই ঘটনা ঘটে আরেকটি দিন নিয়ে। সেটা ৭ নভেম্বর। ৭ নভেম্বরের ‘সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের’ বিরোধীরাও গত ২৬ বছর ধরে এই দিনটিকে ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ আখ্যায়িত করে এক আশ্চর্য সংহতির গল্প ফাঁদে। যেন জীবন ও পেনশনের টাকা নিয়ে চিন্তাক্লিষ্ট বন্দী জিয়া কোনো আশ্চর্য যাদু বলে মুক্ত হলেন এবং বেঁচে রইলেন গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। ৭ নভেম্বরের সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের বিরোধীরা, যারা সামরিক শাসকদের হাত ধরে সমাজ ও রাষ্ট্রের মাথায় চড়ে বসেছেন, যাঁরা বিপ্ল¬ব ও পরিকল্পনাকারী নেতৃত্বের কথা, হাজার হাজার সিপাহীর কথা, বলেন না ঠিক কী কারণে বিদ্রোহ হয়েছিল। বরং সব কিছু ধামাচাপা দিয়ে দেন, নেতৃত্বকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন, হাজার হাজার সিপাহীকে হত্যার কথা চেপে যান, হাজার হাজার সিপাহীকে জেলে ঢোকানোর কথা চেপে যান, চেপে যান হাজার হাজার সিপাহীকে চাকুরিচ্যুত করার কথা। এই চেপে যাবার কারণ খুবই সাধারণ। যে রাজনৈতিক লক্ষ্যে সংঘটিত হয়েছিল ৭ নভেম্বরের বিদ্রোহ, সেই লক্ষ্য অনুযায়ী দেশ চলেনি। তাই সেই রাজনৈতিক লক্ষ্যকে ধামাচাপা দেবার জন্যই চেপে যাওয়া হয় সকল ঘটনা, বিষয় ও নেতৃত্ব।
শূন্য থেকে আপেল পড়ে না। আর হঠাৎ করেই সিপাহীরা বিদ্রোহ করেনি। এর একটা অতীত আছে। এর আছে সামাজিক-রাজনৈতিক কারণ ও প্রেক্ষাপট। একটি সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শন থেকে এটা পরিচালিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ পরিচালনায় মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যর্থতা মুক্তিযুদ্ধকে নাজায়েজ করে না, ’৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের পর ১০ বছরের দেশ পরিচালনার ব্যর্থতা অবৈধ ক্ষমতা দখলদারকে হালাল করে না। ঠিক তেমনি, ৭ নভেম্বরের সিপাহী বিদ্রোহের পর জেনারেল জিয়ার সামরিক শাসনের রাজনীতির ধারা বিদ্রোহের মর্মবস্ত ও লক্ষ্যকে নস্যাৎ করলেও সিপাহী বিদ্রোহের মহিমা এতটুকু ম্ল¬ান হয় না।
বঙ্গবন্ধুর সরকারের বিরুদ্ধে জনগণের বিক্ষোভ ও অভিযোগের কোনো অভাব ছিল না। ঠিক তেমনি তাঁর হত্যাকা- ও খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা দখলের প্রক্রিয়াও জনগণ সমর্থন করেনি বরং ক্ষমতা বলয়ের আশপাশে ধূমায়িত হতে থাকে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সন্দেহ, অবিশ্বাস, আতঙ্ক আর উদ্বেগ। খন্দকার মোশতাককে সামনে রেখে অফিসাররা ক্ষমতা দখলের প্রতিযোগিতা ও পরস্পর বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়। এক পর্যায়ে ৩ নভেম্বর সেনাবাহিনীর চেন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠার দোহাই দিয়ে খালেদ মোশাররফ ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সাথে আপস করে তাদের দেশ থেকে নিরাপদ চলে যেতে দিয়ে, খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে মেনে নিয়ে, সীমাহীন উদাসীনতা দেখিয়ে জেলখানায় ৪ জাতীয় নেতাকে হত্যার সুযোগ করে দিয়ে তিনি ব্যস্ত ছিলেন অথর্ব সেনাপ্রধান জিয়াকে সরিয়ে নিজে সেনা প্রধান হতে। এভাবে বার বার ক্ষমতা দখলের জন্য সিপাহীদের ব্যবহার, ক্ষমতা থেকে চ্যুত হবার সময় সিপাহীদের অন্যদের তোপের মুখে রেখে অফিসারদের পলায়ন, ক্ষমতা কেন্দ্রের সান্নিধ্য পাবার জন্য অফিসারদের প্রতিযোগিতাÑএই সব কিছু সাধারণ সিপাহীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে তোলে।
ওদিকে জিয়াকে যখন বন্দী করা হয়, তখন তিনি বেড রুমের ফোন থেকে কর্নেল তাহেরকে নিজের প্রাণ রক্ষার অনুরোধ জানান। কিন্তু কথা শেষ হবার আগেই লাইন কেটে যায়। তাহের তখন নারায়ণগঞ্জের বাসায় থাকেন। একদল সৈন্যের বিরুদ্ধে আরেক দল সৈন্যকে বন্দুক তাক করে শাসিয়ে অফিসাররা প্রমোশন ও ক্ষমতার উন্মত্ততায় ব্যস্ত থাকার মুহূর্তে সাধারণ সিপাহীরা নারায়ণগঞ্জ গিয়ে কর্নেল তাহেরকে ঢাকায় নিয়ে আসার অনুরোধ জানান। এই সাধারণ সিপাহীরা সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য, তারা এই সঙ্কটকালে ছুটে যান তাদের নেতা তাহেরের কাছে, যিনি ক্ষমতার দৌঁড়ে নিজেকে জড়াননি, ’৭২ সালেই সেনাকাঠামো সম্পর্কে নিজের ভিন্নমত প্রকাশ করে যিনি সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেছেন।
তাহের ঐ দিনই ঢাকা চলে আসেন অসুস্থ অবস্থায়। বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের মাধ্যমে নিয়মিত খোঁজখবর রাখতে থাকেন সেনানিবাসের পরিস্থিতির। তিনি সিপাহীদের নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতী যুদ্ধ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলেন। শত শত সিপাহী তাঁর সাথে দেখা করতে আসতে থাকেন। তাঁরা তাহেরকে ‘কিছু একটা’ করতে বলেন, কিন্তু জাসদ বা বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থার ওপরই সব ছেড়ে দেয়া হয়। তাঁরা তখন একটি লিফলেট ড্রাফট করেন, এটা করেন হাবিলদার বারী এবং নায়েক সুবেদার জালাল। লিফলেটটি ৫ নভেম্বর ভোরে ছাপানো হয় এবং বিকেলে সৈনিক সংস্থার সদস্যদের পড়ে শোনানোর পর রাতে তাঁদের মাঝে বণ্টন করা হয় সিপাহীদের মাঝে বিলি করার জন্য। লিফলেটের বক্তব্য ছিল:
‘অফিসাররা ক্ষমতা দখলের ও পদের লোভে বার বার অভ্যুত্থান ঘটাচ্ছে। আর প্রাণ দিচ্ছে সাধারণ সিপাইরা। নিগৃহীত, অধিকার বঞ্চিত সিপাইরা আর কামানের খোরাক হবে না। সিপাই-জনতার ভাগ্য এক। তাই সিপাই-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমেই ক্ষমতা দখল করতে হবে সুতরাং বিপ্লবের জন্য, শ্রেণী সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হউন।’
এই লিফলেটের বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, সেনাবাহিনীতে কী ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। মূল বক্তব্য ছাড়াও লিফলেটের একটা মুখবন্ধ ছিল, তাতে বলা হয় ‘সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই, সুতরাং সিপাহীরা ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়ান।’ লিফলেটে আরও যে সব বক্তব্য ছিল, তা হলো : যদি অফিসাররা নির্দেশ দেয় আরেক অফিসারের বিরুদ্ধে বন্দুক ধরার জন্য তা হলে সৈনিকরা বন্দুক ধরবে না, বরং ঐক্যবদ্ধভাবে বিদ্রোহ করবে। সর্বশেষ সীমা পর্যন্ত ধৈর্য ধরবে গুলি না ছুড়ে। কোনো উপায় না থাকলে পরস্পরকে হত্যা না করে, গৃহযুদ্ধে লিপ্ত না হয়ে তারা বিদ্রোহ করবে।
এই লিফলেট বিতরণের মাধ্যমেই সিপাহী বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত হয়। ৬ তারিখ ভোরে সাধারণ সিপাহীরা লিফলেট পায়। বিকালে সৈনিক সংস্থার সভায় সিদ্ধান্ত হয় দিবাগত রাত ১১টার পর বিদ্রোহ শুরু করার। এই বৈঠকে বিপ্ল¬বের ৭টি লক্ষ্য স্থির করা হয়: (১) সৈনিকরা সম্মিলিতভাবে বিপ্ল¬ব করবে, (২) ষড়যন্ত্রকারী খালেদকে উৎখাত করা (হত্যা নয়) হবে, (৩) সৈনিকরা সেনাবাহিনী ও জনজীবনে শৃঙ্খলা আনবে, (৪) প্রাতিষ্ঠানিক সেনাবাহিনীর বদলে গণবাহিনী হবে এবং সমাজ সেই লক্ষ্যে পুনর্গঠিত হবে, (৫) বাকশাল ব্যতীত সকল দলের সমম্বয়ে অন্তর্বর্তীকালীন একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার গঠিত হবে, (৬) সকল রাজবন্দির মুক্তি দিতে হবে এবং (৭) চূড়ান্ত লক্ষ্য হবে সাধারণ নির্বাচনে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা।
৬ তারিখ বিকালের এই সভায় বিপ্ল¬বের লক্ষ্য ছাড়াও বিপ্ল¬বকালীন কর্মসূচিও নির্ধারণ করা হয়: (১) রাত ১১টায় ফাঁকা গুলি ছুড়ে বিপ্ল¬বের সূচনা করা হবে, (২) জীবন বাঁচানোর অনিবার্য প্রয়োজন ছাড়া গুলি করা যাবে না, (৩) খালেদ মোশাররফ সাহেবকে গ্রেফতার করতে হবে, (৪) জিয়াকে মুক্ত করা হবে এবং এলিফ্যান্ট রোডে কর্নেল তাহেরের বাসায় নিয়ে আসা হবে, (৫) সৈনিকেরা বিপ্ল¬বের পক্ষে স্লে¬াগান দিয়ে শহর ঘুরবে, (৬) প্রতি ট্রাকে কমপক্ষে একজন সৈনিক সংস্থার লোক থাকবে, (৭) ৭ তারিখ সকালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সৈনিকদের সমাবেশ হবে, (৮) বিপ্ল¬বের পর বেতার- টেলিভিশনে নেতাদের বক্তব্য প্রচার করা হবে, (৯) কোনো ইউনিট লুটপাটে অংশ নেবে না, (১০) বিপ্ল¬বের পর বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থার ইউনিট নেতাদের নিয়ে বিপ্ল¬বী পরিষদ বা রেভ্যুলুশন কমান্ড কাউন্সিল গঠন করা হবে, (১১) সামরিক অফিসারদের বিপ্ল¬ব সমর্থন করার আহ্বান জানানো হবে, যারা করবে না তাদের গ্রেফতার করা হবে, (১২) কর্নেল তাহের বিপ্ল¬বের সর্বাধিনায়ক। সবাই তাঁর নির্দেশ পালন করবে।
নির্ধারিত সময়ের পরে, রাত ১টায় বিপ্ল¬ব শুরু হয়। সৈনিকরা দলে দলে বিদ্রোহ সমর্থন করে তাতে যোগ দিতে থাকেন। রাত ৩টায় বাংলাদেশ বেতারে সাংবাদিক শামসুদ্দীন আহমেদ পেয়ারা প্রথম সিপাহী বিদ্রোহের ঘোষণা দেন। ঘোষণায় বলা হয়:
“বাংলাদেশের বীর বিপ্ল¬বী জনগণ, আজ মধ্যরাত থেকে সারা দেশে সিপাই-জনতার অভ্যুত্থান অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ এবং বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থা ও বিপ্ল¬বী গণবাহিনী ও ছাত্র-যুবক-শ্রমিক সম্মিলিতভাবে দেশে ষড়যন্ত্রকারীদের উৎখাত করে বিপ্ল¬বী অভ্যুত্থান সংগঠিত করেছে। বাংলাদেশের সকল সেনানিবাসের সৈন্য, বিডিআর, পুলিশ, ছাত্র-জনতা এবং সকল স্তরের মেহনতি মানুষের প্রতি আমাদের আহ্বানÑপ্রত্যেক স্ব স্ব এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করুন এবং নিকটস্থ বিপ্ল¬বী গণবাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ করুন। সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান, এই অভ্যুত্থানী শক্তির সঙ্গে রাজপথে সংগঠিতভাবে বেরিয়ে এসে একাত্মতা ঘোষণা করুন। বিপ্ল¬ব দীর্ঘজীবী হোক।”
রাত ৪টার পর থেকে সরকার কবিরউদ্দিন এই ঘোষণা পড়তে থাকেন এবং সকাল ৭টা ৩০ পর্যন্ত এই ঘোষণা বেতারে প্রচারিত হয়। অন্যদিকে রাত ২টার পর থেকে ঢাকায় মাইযোগে ঘোষণা করা হয়: “দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশ, বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থা, বিপ্ল¬বী গণবাহিনী ও ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-কৃষক সম্মিলিতভাবে দেশে ষড়যন্ত্রকারীদের উৎখাত করে বিপ্ল¬বী অভ্যুত্থান সংগঠিত করেছে। সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহ্বান, এই অভ্যুত্থানী শক্তির সঙ্গে রাজপথে সংগঠিতভাবে বেরিয়ে এসে একাত্মতা ঘোষণা করা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সকালে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনীর সকল সৈনিককে উপস্থিত হওয়ার জন্য অনুরোধ জানানো হচ্ছে। মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ও কর্নেল আবু তাহের ভাষণ দেবেন।
ছাত্র ও জনসাধারণকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সমবেত হওয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। সেখানে মেজর জলিল, আ স ম আব্দুর রবসহ সকল নেতৃবৃন্দ ভাষণ দেবেন।
সৈনিক ভাইদের প্রতি, আপনারা অযথা আকাশে গুলি ছুড়বেন না। সবাই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমবেত হোন।
ডবপ্ল¬বী গণবাহিনীর সদস্যদের প্রতি নির্দেশÑকঠোর শৃঙ্খলা বজায় রাখুন, পাড়ায়-মহল¬ায় শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা করুন। বিপ্ল¬বী গণবাহিনীর হেডকোয়ার্টার থেকে প্রচারিত নির্দেশ মেনে চলুন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সান্সেস এনএক্স ভবনে অস্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। যে কোনো প্রয়োজনে সেখানে যোগাযোগ করুন।
এদিকে রাত ১টায় জিয়াকে মুক্ত করা হয়। কিন্তু রাস্তায় বিদ্রোহের পক্ষের গুলির আওয়াজকে বিপদ ভেবে তাকে টু ফিল্ড আর্টিলারিতে নেয়া হয়। সেখানে জিয়ার আশপাশে সৈন্যরা জমায়েত হলে সে অফিসারদের তার কাছে আনার নির্দেশ দেয়। তার পাশে অন্য অফিসাররা চলে আসে। জিয়াকে তাহেরের কাছে আনা সম্ভব হয় না। রাত সোয়া ২টার দিকে কর্নেল তাহের, আমি ও অল্প ক’জন টু ফিল্ড আর্টিলারিতে যাই। জিয়ার সাথে আলাপ হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন সম্পর্কে আলাপ হয়। জিয়া কোনো কথা বলেননি, চুপ করে ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের সমাবেশে প্রকাশ্যে কর্মপন্থা ঘোষণার কথা বলা হবে জিয়া জানান, “আমি রাজনীতিবিদ নই এবং আমি কোনো জনসভায় ভাষণ দিতে পারব না। তোমরা যা ভাল মনে করো আমি তার সঙ্গে আছি, কিন্তু আমি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেতে পারব না।”
এ অবস্থায় তাহের জিয়াকে বেতার ভাষণ দিয়ে দেশবাসীকে পরিস্থিতি জানানোর কথা বললে সে বেতারে না গিয়ে টু ফিল্ড আর্টিলারিতে ভাষণ রেকর্ডিং করে। এই ভাষণ সকাল ৮টা থেকে প্রচার করা হয়। কিন্তু ভাষণে বিদ্রোহ সম্পর্কে কোনো কথা ছিল না, বরং জিয়া নিজেকে সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে ঘোষণা দেন। ফলে সিপাহীরা ও তাহের অন্তরালে যেতে থাকেন, আর জিয়া ক্ষমতা কেন্দ্রের দিকে যেতে থাকেন।
সকাল ৮টায় টু ফিল্ড আর্টিলারিতে তাহের জিয়াকে সৈনিকদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিলে জিয়া তেমন কিছু বলেননি, শুধু লিখিতভাবে বক্তব্য ও দাবি-দাওয়া চান।
সকাল ১১টায় আরেকটি বৈঠকে তাহের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দেন: (১) কারাগারে আটক ৬২ হাজার বন্দীর মুক্তি, (২) রাজনৈতিক নেতাদের ওপর থেকে হুলিয়া প্রত্যাহার, (৩) প্রকাশ্য রাজনৈতিক তৎপরতা চালু করা, (৪) গণমাধ্যমগুলোর ওপর থেকে সেন্সরশিপ প্রত্যাহার করা, (৫) বাকশাল বাদ দিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠন, (৬) সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং (৭) সিপাহীদের আর্থিক মানবিক সমস্যার সমাধান। প্রস্তাবগুলো জিয়া মেনে নেন।
এই বৈঠকে জিয়ার সাথে আরও উপস্থিত ছিলেন এমজি তোয়াব, এম এইচ খান, খলিলুর রহমান, মাহবুব আলম চাষী, ওমসানী এবং তাহের। এখানে চাষী ও ওসমানী মুশতাককেই রাষ্ট্রপতি রাখার প্রস্তাব দেন। তাহের এই প্রস্তাব বাতিল করে দেন। খলিল সায়েমকে রাষ্ট্রপতি ও সিএমএলও করার প্রস্তাব দিলে অন্যরা তা মেনে নেন। এতে জিয়াসহ তিন বাহিনীর প্রধানরা ডিসিএমএলএ হয়ে যান।
টু ফিল্ড আর্টিলারির এই বৈঠকের পর তাহের এলিফ্যান্ট রোডের বাসায় চলে আসেন। এখানে সিপাহীদের ১২ দফা দাবি প্রণয়ন করা হয় বিকাল ৫টা নাগাদ। সন্ধ্যা ৭টায় বেতারে জিয়াকে ঘেরাও করে ১২ দফা পেশ করা হয়। তিনি ১২ দফার তিনটি কপিতে স্বাক্ষর করেন, একটি নিজে নেন, এক কপি সৈনিক সংস্থা নেয় ও আরেক কপি বেতারে প্রচারের জন্য দেয়া হয়। কিন্তু বেতারে ও পরবর্তীতে পত্রিকায় তা প্রচার করতে জিয়া না করে দেন। এই ১২ দফায় ছিল:
(১) আমাদের বিপ্ল¬ব সংঘটিত হয়েছে সমাজের দরিদ্র শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য। আমাদের বিপ্ল¬ব নেতা বদলের জন্য নয়। বহু বছর ধরে আমরা ধনিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য সামরিক বাহিনীতে চাকরি করেছি। সেজন্য জেনারেল জিয়াকে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করতে হবে যে, সশস্ত্র বাহিনীর বর্তমান কাঠামোর পরিবর্তন করে দরিদ্র শ্রেণীর তিনি নেতৃত্ব দেবেন। ধনীরা তাদের স্বার্থে আমাদের ব্যবহার করেছে। ১৫ আগস্টের ঘটনা তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। আমাদের এবারের বিপ্ল¬ব ধনিক শ্রেণীর স্বার্থরক্ষার জন্য নয়। আমরা জনগণের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বিদ্রোহ করেছি। এখন থেকে সশস্ত্রবাহিনী আপামর জনসাধারণের স্বার্থরক্ষার জন্য নিজেদেরকে গড়ে তুলবে। আজ থেকে বাংলাদেশের সেনাবাহিনী হবে গরিব শ্রেণীর স্বার্থরক্ষাকারী গণবাহিনী।
(২) জলিল-রবসহ অবিলম্বে সকল রাজবন্দিকে মুক্তি দিতে হবে।
(৩) রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না।
(৪) অফিসার ও জওয়ানদের ভেদাভেদ দূর করতে হবে। অফিসারদের আলাদাভাবে নিযুক্ত না করে সামরিক শিক্ষা ও যোগ্যতা অনুযায়ী সামরিক বাহিনী থেকেই পদমর্যাদা নির্ণয় করতে হবে।
(৫) অফিসার ও জওয়ানদের একই রেশন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। সিপাহীদের, বেতন ৭ম গ্রেড করতে হবে এবং বাসস্থানের ভাড়া কর্তন বন্ধ করতে হবে।
(৬) অবিলম্বে অফিসারদের ব্যক্তিগত চাকর হিসাবে ব্যবহৃত ব্যাটম্যান প্রথা বাতিল করতে হবে।
(৭) প্রতিরক্ষা সার্ভিসে ঔপনিবেশিক আমালের প্রচলিত রীতি-নীতি তথা ব্রিটিশ আমলের আইনকানুন বদলাতে হবে।
(৮) মুক্তিযুদ্ধ, গণঅভ্যুত্থান এবং আজকের বিপ্ল¬বে যে সমস্ত দেশপ্রেমিক ভাই শহীদ হয়েছেন তাঁদের পরিবারের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।
(৯) সমস্ত দুর্নীতিবাজের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে হবে। বিদেশে যারা টাকা জমিয়েছে তাদের টাকা বাংলাদেশে ফেরত আনতে হবে।
(১০) যে সমস্ত সামরিক অফিসার ও জওয়ানকে বিদেশে পাঠানো হয়েছে তাদের দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
(১১) পাকিস্তান ফেরত সামরিক বাহিনীর লোকদের ১৮ মাসের বেতন দিতে হবে।
(১২) বিপ্ল¬বী সৈনিক সংস্থা সশস্ত্রবাহিনীর কেন্দ্রীয় নীতি নির্ধারণী সংস্থা হিসাবে কাজ করবে। জিয়া সশস্ত্রবাহিনী সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্ত এই সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে গ্রহণ করবে।
জিয়ার ধূর্ততা সৈনিকরা টের পেয়ে যায়। ৮ তারিখ সকাল ১১টায় বিদ্রোহ দমনের জন্য জিয়া গ্যারিসন হল অডিটরিয়ামে সৈনিকদের নিয়ে সভা করেন। এখানেও সৈনিক সংস্থার চাপে জিয়া ১২ দফার ২ কপিতে সই করেন।
৭ তারিখ রাত থেকেই জিয়াকে ঘিরে প্রতিক্রিয়াশীল অফিসাররা সমবেত হতে থাকেন। তারা জিয়াকে ‘জাসদের কথা শুনো না’ বলে হুমকিও দেন। এ তারিখ থেকে জিয়ার সাথে তাহেরের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। জিয়া সিপাহী বিদ্রোহের সকল দাবি ও মর্মবস্তুর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা শুরু করেন। সূত্রপাত করেন সামরিক শাসনের রাজনীতির।
অতি অল্পদিনের মধ্যেই নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করেই জিয়া ঘুরে দাঁড়ান সিপাহী বিদ্রোহের নেতা-সংগঠক-সমর্থকদের ধ্বংস করতে। ২৩ নভেম্বর গ্রেফতার করা হয় কর্নেল তাহেরকে। পরবর্তীতে অন্যান্য জাসদ নেতা ও সৈনিক সংস্থার সদস্যদেরকেও। কর্নেল তাহেরসহ জাসদ নেতৃবৃন্দ ও সৈনিক সংস্থার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গকে গোপন বিচার-প্রহসনের মুখোমুখি করা হয়। তাহেরের মৃত্যুদ- ঘোষণা করা হয় এবং অতি দ্রুত তা কার্যকর করা হয়। জিয়া শুধু সিপাহী বিদ্রোহের চিহ্ন মুছে ফেলতে সেনানিবাসগুলোতে হাজার হাজার সৈনিককে হত্যা করেন, গুম করেন, জেলে ঢোকান ও চাকরিচ্যুত করেন। কিন্তু তাঁর সে অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আজ সবাই জানেন সিপাহী বিদ্রোহের নেতা কে ছিলেন, এর রাজনৈতিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-বা কী ছিল। আজকে ২১ শতকে বিশ্বের দেশে দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধগুলোর পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য এবং একটি জবাবদিহিমূলক স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণের জন্য দেশে দেশে সামরিক শাসক ও স্বৈরাচারী শাসকদের বিভিন্ন অপকর্মের অনুসন্ধান ও বিচার করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশে দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে সাংবিধানিক শাসনের ধারা সূচিত হয়েছে। অনেক দেরিতে হলেও এখানে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জেলহত্যার বিচার হয়েছে। অবৈধ ক্ষমতা দখলদার ও সামরিক সরকারসমূহের পদক্ষেপ এবং সামরিক আইন আদালতসমূহের বিচার কার্য ন্যায়বিচার ও মৌলিক অধিকার পরিপন্থী, বেআইনী। ৭ নভেম্বরের পূর্ণ চেতনায় এ দেশ গড়ে তোলার কাজটা শুরু করতে হলে দরকার আজ দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা এবং গণতন্ত্রকে নিরাপদ করা। এর জন্য দরকার অবৈধ ক্ষমতা দখল, সংবিধান লঙ্ঘন ও সামরিক আইন-আদালতসমূহের বিচার কার্যক্রমকে অবৈধ ঘোষণা, কর্নেল তাহের হত্যা, হাজার হাজার সিপাহী ও নেতাকর্মীর হত্যার বিচার শুরু আজ অত্যন্ত জরুরি।