top of page

মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে

মুক্তিযোদ্ধারা আবার জয়ী হবে

আবু তাহের

পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ১১ নং সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে একটা জিনিস দেখে বারবার অবাক হয়েছি। দেখেছি প্রত্যয় আর দৃঢ়তায় সকালের সূর্যের মত হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য নির্বাচিত হতে না পেরে অতৃপ্তির ব্যথা নিয়ে ফিরে গেছে। তারপর ইউথ ক্যাম্পে অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন, কখন জীবন দেবার ডাক আসে। মহেন্দ্রগঞ্জ, মাইনচারচর, ডালু ও অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় ওরা আমাকে ঘিরে ধরেছে। সবারই এক প্রশ্নÑআর কতদিন অপেক্ষা করবো? একজন সৈনিক হিসেবে আমি বুঝতে পারি কখন মানুষ ভয়াবহ যুদ্ধকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে। রিক্রুটিং সেন্টারে লাইন দেখে আমি বুঝেছি, এ যোদ্ধারা জয়ী হবেই। কারণ পৃথিবীতে এমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে যোগ দেয়ার দৃষ্টান্ত আর নেই। গণচীন থেকে শুরু করে ইন্দোচীনের স্বাধীনতা যুদ্ধ, কোনটাই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের মত এ দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি। ভিয়েতনাম, কিউবাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতির সঙ্গে। সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক-সামরিক নেতৃত্ব ছাড়া বাংলার তরুণরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই। মুক্তিযোদ্ধারা এই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। অন্য কেউ নয়। যদি কোন দল বা গোষ্ঠী এককভাবে মুক্তিযোদ্ধা তথা জনগণের এই বিজয়কে নিজের বলে মনে করে তা হবে সর্বৈব মিথ্যা। পাকিস্তানী উপনিবেশিক শক্তির শোষণ এত তীব্র ছিল যে, বাঙালি জাতির জাতীয়তাবোধ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কারণ হবার প্রখরতা অর্জন করেছিলো। জাতীয় শোষণ থেকে মুক্তি পাবার তীব্র আকাঙ্খা এদেশের জনগণ তথা তরুণ সমাজকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার শক্তি যুগিয়েছে। এ কৃতিত্ব জনগণের আর জনগণের যোদ্ধা তরুণ সম্প্রদায়ের নিজস্ব। মুক্তিযুদ্ধ দানা বাঁধার মতো বাস্তব অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা ২৫ মার্চের আগে বিদ্যমান থাকলেও সঠিক রাজনৈতিক দলের অভাব থাকার দরুণ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়নি। মার্চের প্রথম সপ্তাহেও মানুষ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়নি, যদিও শহুরে কিছু সংখ্যক বিপ্লবী তরুণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলো। ২৬ শে মার্চ থেকে যে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয় তা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। ২৫ শে মার্চের বর্বর আক্রমণ যদি পাকসেনারা না চালাতো তবে এ স্বতঃস্ফূর্ত সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হতে আরও দেরী হতো বলেই আমার ধারণা। এ প্রতিরোধ সশস্ত্র হলেও সাথে সাথে তা মুক্তিযুদ্ধে রূপ নেয়নি। এদেশের জনগণের কোন সামরিক অতীত ইতিহাস না থাকাতে এই প্রাথমিক অবস্থায় জনগণ অস্ত্র তুলে নেবার আকাঙ্খা সত্ত্বেও সাথে সাথে তা পারেনি। তবে সামরিক ঐতিহ্যহীনতার এই অভাব জনগণ কয়েকমাসেই সাহসিকতার সাথে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পেরেছিলো। মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে অল্পসংখ্যক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই. পি. আর. (বর্তমান বি. ডি. আর.) ও পুলিশ বাহিনীর সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ এই নিয়মিত বাহিনীগুলোকে যুদ্ধের চিরাচরিত প্রথা ছেড়ে গেরিলা যুদ্ধের রীতিনীতির ওপর শ্রদ্ধা আনতে কিছুটা সাহায্য করেছিল। আর ঠিক তখনই অর্থাৎ জুন মাসে এদেশে গেরিলা যুদ্ধের সূচনা হয়। মুক্তিফৌজ গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন অঞ্চলে। জুলাই মাসে মুক্তিযুদ্ধ একটা রূপ নেয়। মুক্তিযোদ্ধারা ছড়িয়ে পড়তে থাকে গ্রামে। আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধ পূর্ণাঙ্গ রূপ নেয় আর সেপ্টেম্বরে তা জোরদার হয়ে ওঠে।
এই কৃতিত্ব অর্জনের পর আমি মনে করেছিলাম আমরা হয়ত মুক্তিযুদ্ধের ক্ষেত্রে পৃথিবীতে এমন একটা দৃষ্টান্ত রাখতে পারবো, যা নাকি এশিয়ার মুক্তিকামী জাতিসমূহকে জাতীয় মুক্তির প্রেরণা যোগাবে। বস্তুতঃ মুক্তিযোদ্ধারাই হয়ে পড়েছিল বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ। তাদের ওপর নির্ভর করেছিলো আমাদের জাতীয় স্বাধীনতা। বিজয় তাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। মুক্তিযোদ্ধারা প্রমাণ করেছিলো যুদ্ধের অতীত ইতিহাস না থাকা সত্ত্বেও একটি শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে দেশপ্রেমিক যোদ্ধারা ঘায়েল করতে পারে। গেরিলা যুদ্ধের সবচেয়ে বড় উপাদান ‘জনগণের আস্থা’ মুক্তিযোদ্ধাদের ছিল। এটাকে বজায় রেখে রাজনৈতিক, সামরিক, সামাজিক জীবনের সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই ছিল তখন তাদের ঐতিহাসিক কর্তব্য।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা সে নেতৃত্ব নিতে ব্যর্থ হয়েছিলো। তবু নভেম্বর মাসের মধ্যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের চরম অভাব থাকা সত্ত্বেও সামরিক দিক থেকে অবস্থা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুকূলে এসে যায়। মূলতঃ পাক সেনারা তখন প্রতিটি অবস্থানেই ঘেরাও হয়ে পড়ে। চলমান শত্রুরা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু। কিন্তু সঠিক নেতৃত্ব, যা তাদেরকে জনগণের সাথে সংযুক্ত করে, গেরিলা যুদ্ধের প্রধান উপাদানকে বিকশিত করে, তা না থাকায় গুণগত দিক থেকে সার্বিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণাত্মক বিকাশ ঘটতে থাকে। এই সময়েই আমি এই সমস্যার গুরুত্ব অনুধাবন করি। তখনই এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে রণনীতির এ সমস্যা মূলতঃ জনগণের সঙ্গে সৈনিকদের সম্পর্কের সমস্যা। কাজেই এ সমস্যার সমাধান করতে হলে জনগণের সঙ্গে সৈনিকদের সম্পর্ককে নির্ণয় করতে হবে। দুঃখজনক ভাবে তখনই নিয়মিত ও অধিকাংশ গেরিলা সৈনিক মনে করতেন: যেহেতু তারা যুদ্ধ করছেন, সেহেতু জনগণ তাদের সাহায্য করবে, এই মানসিকতাই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ঋণাত্মক বিকাশের জন্য দায়ী ছিল। যুদ্ধরত নিয়মিত সৈনিকেরা এ সত্যকে কোন দিনই অনুধাবন করতে পারেনি, আর তাদের পক্ষে পারাটাও সম্ভব ছিল না। তাদের ও ভারতীয় বাহিনীর হাতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারাও এ সমস্যাকে প্রাথমিক অবস্থায় উপলব্ধি করতে পারেনি। তবুও গেরিলা যোদ্ধাদের মাঝে অক্টোবর মাস থেকেই এ সমস্যাকে স্বীকার করে নেবার প্রবণতা লক্ষ্য করেছি যা নভেম্বর মাসে রীতিমত একটি সম্ভাবনা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এটা ছিল বিকল্প। যে সমস্যা সমাধান করবে রাজনৈতিক বিভাগ, তাকে সামরিক বিভাগ বাধ্য হয়ে কার্যক্রমের আওতায় ফেললো। নিয়মিত সৈনিকদের কোন আদর্শগত ভিত্তি না থাকায় তারা কোনদিনই জনযুদ্ধকে রূপ দিতে পারতো না। তারা ছিল অবস্থার শিকার। ফলে প্রথম পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মাঝে এ সমস্যার সৃষ্টি হওয়াটাই স্বাভাবিক ছিল। এই সময় আমি মুক্তিযোদ্ধাদেরকে জনগণের সাথে তাদের সম্পর্ককে সুস্পষ্ঠ রূপ দিতে আহ্বান জানাই। এ যুদ্ধ ছিল উপনিবেশিক পাকিস্তানীদের সাথে জনগণের যুদ্ধ। জনগণ তাই মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন করেছে। শুধু যুদ্ধ করলেই জনগণের সাথে সংযুক্ত হওয়া যায় না। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের জনগণের সাথে সংযুক্ত হতে হয়। এ যুদ্ধ জনযুদ্ধ-জনগণের যুদ্ধ। যুদ্ধও জনগণের জীবনের যেমন একটা অঙ্গ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, সামাজিকতা, প্রশাসন ইত্যাদিও তার জীবনের অঙ্গ। তাই তখন ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের বলতাম: কৃষকের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে তার খাসী আর মুরগী খেয়ে গেরিলা যুদ্ধ হয় না…..যদি কোন কৃষকের গোয়ালে রাত কাটাও সকালে গোবরটা পরিষ্কার করো। যেদিন অপারেশন না থাকে, তোমার আশ্রয়দাতাকে একটা উববঢ় ঞৎবহপয খধঃৎববহ তৈরী করে দিও। তাদের সাথে ধান কাটো, ক্ষেত নিড়াও। এগুলো হলো জনগণের সাথে সংযুক্ত হবার পদ্ধতি। এটাকে রপ্ত করা, শিক্ষা দেয়া ও প্রয়োগ করার দায়িত্ব ছিল রাজনৈতিক নেতাদের, যারা প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা ইউনিটকে এ শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবে। প্রয়োজন ছিল রাজনৈতিক শিক্ষকের, যারা গেরিলা যুদ্ধের অভিধানে রাজনৈতিক উপদেষ্টা নামে পরিচিত। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এটাকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের ভাড়াটে সৈনিক হিসাবে গণ্য করলো। এ সময়ে আমি আমার সেক্টরে রাজনৈতিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনের জন্য কিছুসংখ্যক সচেতন অধ্যাপককে ‘অপারেশন অফিসার’ হিসাবে নিয়োগ করি। এতে বিশেষ সুফল পাওয়া গিয়েছিলো। সমগ্র বাংলাদেশে গেরিলারা কোন একক কমান্ডের অধীন ছিল না। মূলতঃ সামরিক নেতৃত্বে ছিল কেন্দ্রীকতার অভাব আর রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিল সামরিক ব্যুৎপত্তির অভাব। সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্ব একদিকে ছিল দুর্বল, অপরদিকে অসমন্বিত। সামরিক নেতৃত্বের রাজনীতিকরণ মোটেও হয়নি।
ঠিক ক্রান্তিলগ্নে এলো ১৬ই ডিসেম্বর।
১৬ই ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য স্বাভাবিক বিজয়ের ফলশ্রুতি ছিল না। ১৬ই ডিসেম্বর ছিল দেউলিয়া রাজনীতির অধৈর্যতার ফল। তথাপি মুক্তিযোদ্ধারা তখন সশস্ত্র চরম শক্তির অধিকারী। কিন্তু নেতৃত্বের শূন্যতায় কখন যে নেতৃত্ব ও ক্ষমতার হাত বদল হয়ে গেলো তা মুক্তিযোদ্ধারা উপলব্ধি করতে পারলো না। শুধু মুক্তিযোদ্ধা কেন, সরলপ্রাণ বাংলার মানুষও বুঝতে পারলো না যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃতপক্ষে নিশ্চল করে দেয়া হয়েছে; জয়ী হয়েও মুক্তিযোদ্ধারা হেরে গেছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করা হলো। তথাপি মুক্তিযোদ্ধারা স্বাভাবিকভাবেই ভাবলো নেতৃত্ব তাদেরই হাতে। ভাবলো তাদের কৃতিত্বের জন্য জনগণ তাদেরকে চিরদিন সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে বসিয়ে রাখবে। এদিকে জনজীবনে নেমে এলো চরম দুর্দশা। অর্থনৈতিক, সামাজিক তথা সার্বিক অধপতনে জনজীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠলো। এ অধপতনের জন্য মুক্তিযোদ্ধারাই দায়ী হয়ে পড়লো জনগণের কাছে। চরম নৈরাশ্য মুক্তিযোদ্ধাদের পঙ্গু করে দিল। জাগ্রত হল অপরাধবোধ, নৈতিক অধপতন ঘটলো তরুণ সমাজের। এক অশুভ শক্তি, মুক্তিযোদ্ধা আর রাজাকারের প্রভেদরেখাকে ক্রমে মুছে দিতে শুরু করলো । মুক্তিযোদ্ধারা হলো হীন ষড়যন্ত্রের শিকার।
মুক্তিযুদ্ধে সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দেশে, মানুষের মধ্যে আসে দেশ গড়ার উদ্যম ও উদ্দীপনার জোয়ার, সেই উদ্যম ও উদ্দীপনার জোয়ার মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমি লক্ষ্য করেছি বাংলার মানুষের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। কিন্তু যে ষড়যন্ত্র মুক্তিযোদ্ধাদের পঙ্গু করে দিয়েছে, সেই ষড়যন্ত্র দেশ গড়ার উদ্যমকে ব্যর্থ করে দিল। অপর দিকে জনগণ এটাকে মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতকর্মের ফল ভেবে ভুল করলো। কারণ মুক্তিযোদ্ধারা এনেছে সামরিক বিজয়। জনগণ এদের নেতৃত্বকে স্বীকার করে নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা নেতৃত্ব হারিয়েও জনগণের মনে নেতৃত্বের আসনে বসে আছে। সেজন্য তারা তাদের সমস্ত দুর্গতির জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের দায়ী করলো। কারণ তারা জনগণের নিজস্ব লোক, পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নেতৃত্বের আইনানুগ উত্তরাধিকারী।
বাংলার দুর্ভাগ্য আইনানুগ উত্তরাধিকারীর বদলে সর্বস্তরের নেতৃত্ব এসেছে তাদেরই হাতে যারা প্রাক বিপ্লব যুগে ছিলেন ক্ষমতার উৎস। প্রশাসন যন্ত্র সেই পুরোনো ব্যক্তিরাই চালান। বাণিজ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও তারাই। যে সামরিক অফিসার পাকিস্তানী সৈন্যদের সাথে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্মূল করার জন্য ছিলেন সচেষ্ট তিনি আজ আরও উচ্চ পদে সমাসীন। যে পুলিশ অফিসার দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে সোপর্দ করেছে পাকিস্তানীদের হাতে তিনি আবার মুক্তিযোদ্ধাদের নামে হুলিয়া বের করতে ব্যস্ত। যে আমলারা রাতদিন খেটে তৈরী করেছে রাজাকার বাহিনী তারা মুক্তিযোদ্ধাদেরকে চাকুরী দিয়ে দয়া প্রদর্শনের অধিকারী। যে শিক্ষক দেশের ডাকে সাড়া দিতে পারেনি তিনিই আজ তরুণদের শিক্ষা দেওয়ার বাহানা করছেন।
পরিকল্পনা বিভাগের যে কর্মীকে শোষণের পরিকল্পনা করা শেখানো হয়েছে বছরের পর বছর ধরে তিনিই এখন সমাজতন্ত্রে উত্তরণের পরিকল্পনা তৈরী করেন। যুদ্ধ চলাকালে যারা পাকিস্তানীদের হয়ে প্রচারণায় মত্ত ছিলেন, ১৬ই ডিসেম্বরের পর তারাই ভোল পাল্টিয়ে সংস্কৃতির মধ্যমণি হয়েছেন। অথচ মুক্তিযুদ্ধের পর প্রত্যেক দেশে করা হয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধকে যারা সাহায্য করেনি তারা স্থান পেয়েছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। সেখানে কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে তাদেরকে আত্মশুদ্ধির সুযোগ দেয়া হয়েছে, যাতে করে তারা বিপ্লবী জনতার অংশ হতে পারে। নিতান্তই পরিতাপের বিষয়, যাদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে থেকে আত্মশুদ্ধি করার কথা, সকলের অগোচরে তারা সর্বস্তরে নেতৃত্বের আসন দখল করে বসেছে।
আজ ষড়যন্ত্রের প্রচার বিভাগের মাইক্রোফোন হয়ে দাঁড়িয়েছে উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণীর সুযোগ সন্ধানীরা। এরা চরিত্রগতভাবে দুমুখো, সুবিধাবাদী ও দোদুল্যমান। ২৫ শে মার্চের আগে এরা স্বাধীনতার বড় মিত্র ছিল। এরা ভেবেছিল অবাঙালি ও পাকিস্তানীরা বিতাড়িত হলে পুঁজির বিকাশ ও চাকুরীসহ সর্বক্ষেত্রে তারা সুবিধা পাবে। ২৫ শে মার্চের পর যখন মুক্তিযুদ্ধের সূচনা হলো তখন রাতারাতি তারা হয়ে উঠলেন পাকিস্তান-পসন্দ। পাক সেনাদের পথ দেখানো আর সাহস যোগানো তাদের একান্ত কর্তব্য হয়ে উঠলো। স্বাধীনতার পর এরা আবার দেশপ্রেমিক হলেন। আজ জনগণের চরম দুর্যোগের ক্ষণে বিদ্বেষ ও ঘৃণা সৃষ্টির অপচেষ্টা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের একান্ত কর্তব্য।
এরা বিশ্বাসঘাতক, সর্বযুগে সর্বক্ষেত্রে দেশদ্রোহি, ক্ষমার অযোগ্য। এরা বাংলার সরল জনগণের মাথার বোঝা। এই বোঝাকে ঝেড়ে ফেলতে হবে। নির্মূল করতে হবে এদেরকে, যাতে বাংলাদেশে আর বিশ্বাসঘাতকতার পুনরাবৃত্তি না হয়।
সূত্র:
মুক্তিযোদ্ধাদের মুখপত্র ‘গ্রেনেড’ পত্রিকা প্রকাশ উপলক্ষে কর্নেল তাহের এই প্রবন্ধটি লিখেছিলেন। ১৯৮৬ সালের জুলাইয়ে তাঁর ১০ম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রকাশনা ‘ইশতেহার’ থেকে সংগৃহীত।
ক্স ‘সমগ্র জাতির মধ্যে আমি প্রকাশিত’; আবু তাহেরের ৭৩তম জন্মদিন ও সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের ৩৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে কর্নেল তাহের সংসদের স্মারক প্রকাশনা। (১৪ নভেম্বর, ২০১১)।

bottom of page