top of page

পদত্যাগ

সেনাবাহিনী থেকে কর্নেল তাহের এর পদত্যাগপত্র

(মূল ইংরেজি থেকে অনূদিত)

মাননীয় প্রেসিডেন্ট,
গণ-প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ, সমীপেষু

মাধ্যম: যথাযথ কর্তৃপক্ষ

বিষয়: পদত্যাগ

মহোদয়,
আমি ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করি এবং ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই তারিখে এই সেনাবাহিনী ত্যাগ এবং সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আগমন করা পর্যন্ত সেখানে নিযুক্ত ছিলাম। সীমান্ত অতিক্রম করে আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি এবং একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ১১নং সেক্টরে দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে কাজ শুরু করি। ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর তারিখে একটি সম্মুখ সমরে আমি আঘাতপ্রাপ্ত হই। আমাকে ভারতের এক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আমি ১৯৭২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত অবস্থান করি। বাংলাদেশে ফিরে আসার পর আমাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জেনারেল হেড কোয়ার্টারে অ্যাডজ্যুটেন্ট জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। দু’মাস পরে আমাকে জেনারেল হেড কোয়ার্টার থেকে বদলি করা হয় এবং ৪৪নং ব্রিগেডের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এখন সেনা বাহিনীর চিফ অব স্টাফ, ডি ডি পি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের জন্য আমাকে বলেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকুরিতে অবস্থান করার আমার কোনো ইচ্ছে আর নেই এবং নিম্নলিখিত কারণে আমাকে অব্যাহতি দেয়ার ইচ্ছে আমি পোষণ করি।
(ক) ১৯৭১ সালের আগস্টের গোড়ার দিকে যখন মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করি, আমি দেখতে পাই মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন রকম অসুবিধার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। গণপ্রতিনিধিরা যেমন এমএনএ এবং এম.পি.এ.-রা মুক্তিযুদ্ধ থেকে নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করছে এবং কোনোভাবেই মুক্তিযুদ্ধকে তারা বিস্তৃত করার ব্যাপারে সাহায্য করেনি। এমনকি তারা এও বলাবলি করে যে তারা কেবল প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিল। স্বাধীনতা চায়নি। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এ ধরনের বহু প্রতিনিধি ঘৃণার বস্তুতে পর্যবসিত হয় এবং আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সব সময়ই উপদেশ দিতাম এমএনএ এবং এম.পি.এ.-দের প্রতি রূঢ় না হওয়ার জন্য। এই জন্য যে, স্বাধীনতা অর্জনের পর এই ধরনের গণপ্রতিনিধিরা জনগণকে নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ পাবে না।
সম্ভবত এই ভয়েই মুজিবনগরে অবস্থিত অস্থায়ী সরকার ভারতের সঙ্গে একটি অপমানজনক গোপন চুক্তিতে প্রবেশ করে এবং স্বাধীনতা শেষে তাদের ক্ষমতায় বসবার জন্য ভারতের সশস্ত্র সাহায্য এবং সহযোগিতা লাভ করে। যখন মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা সব ক্ষেত্রই প্রস্তুত, তখনই ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং সম্পদ লুটে নিয়ে যায়। অস্থায়ী সরকার এভাবেই মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে। এ প্রসঙ্গে আমি হলিডে পত্রিকায় প্রকাশিত কর্নেল জিয়াউদ্দিনের লেখা ‘হিডেন প্রাইস’ প্রবন্ধটির উল্লেখ করছি। এমনকি আমি এই চিন্তাটুকু গ্রহণ করতে প্রস্তুত রয়েছি যে আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু চুক্তিটি সংশোধন করবেন এবং দেশের প্রগতি এবং সমৃদ্ধির জন্য বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।
আমি চিন্তা করেছিলাম বাংলাদেশের জন্য একটি গৌরবজনক সেনাবাহিনী গড়ে তুলব। আমি ছাউনিতে অবস্থানকারী সেনাবাহিনীতে কাজ করেছি এবং আমি বুঝতে পারি একটি অনুন্নত দেশের জন্য এই ব্যারাক আর্মি কতটুকু বিপজ্জনক হতে পারে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সঙ্গে জনগণের কোনো ধরনের সম্পর্ক নেই বলেই এমন স্বেচ্ছাচারী ধরনের শাসনের ফলে বাংলাদেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল এবং সর্বশেষে দেশটিকে ধ্বংস করে ফেলে। আমি উৎপাদনশীল গণমুখী সেনাবাহিনী, যা দেশের প্রগতির জন্য অত্যন্ত কার্যকরী মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে, সে ধরনের একটি সেনাবাহিনী গড়ে তোলার ধারণা নিয়ে কাজ করতে শুরু করি। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ এবং আরও কিছু উচ্চপদস্থ অফিসার আমার এই ধারণার ব্যাপারে কোনো ধরনের উৎসাহ ও সহযোগিতা দান করেননি। এই মৌলিক বিষয়ে সেনা বাহিনীর চিফ অব স্টাফের সঙ্গে আমি মতৈক্যে পৌঁছতে পারিনি।
(খ) প্রধানমন্ত্রী আন্তরিকভাবে চাইতেন চিকিৎসার জন্য যাতে আমি বিদেশে যাই। যখন আমি দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলাম তখন আমি জানতে পারি যে, মন্ত্রিসভার জনৈক সদস্যসহ সেনাবাহিনীর কিছু অফিসার প্রধানমন্ত্রীর দেশে অনুপস্থিতির সুযোগে দেশের ক্ষমতা গ্রহণের চেষ্টা করছে (সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ ইতিমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীকে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত করেন)। আমি তখন ভাবলাম প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরা পর্যন্ত আমার বিদেশে গমন স্থগিত রাখা উচিত। ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলোই না উপরন্তু সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ আমাকে ৪৪নং ব্রিগেডের কমান্ড ত্যাগ করে ডি ডি পি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলেন। আমি অনুভব করছি ষড়যন্ত্র এখনো চলছে এবং আরও অনেকে এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে। এ ধরনের ক্ষমতা দখল হচ্ছে সামগ্রিকভাবে জনগণের আশা-আকাঙ্খার বিরুদ্ধে এবং এটাকে অবশ্যই রুখতে হবে। যদি ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হয়, তাহলে সেনাবাহিনীর যে সুনাম রয়েছে তা নষ্ট হবে এবং সেনাবাহিনীতে আমার কাজ করা সম্ভব নয়। আমি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম একজন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অফিসার হিসেবে নয় বরং একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, আমি এটাকে আমার জন্য অত্যন্ত সম্মানজনক বলে মনে করি। জনগণের স্বার্থই আমার কাছে সর্বোচ্চ। আমি সেনাবাহিনী ত্যাগ করে জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই; যারা মুক্তিযুদ্ধকালীন আমার চারদিকে জড়ো হয়েছিল। আমি তাদের বলবো কী ধরনের বিপদ তাদের দিকে আসছে।
আমার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা হলে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ থাকব।

আপনার একান্ত বাধ্যগত
লে. কর্নেল এম এ তাহের
কমান্ডার, ৪৪ ব্রিগেড
কুমিল্লা সেনানিবাস।
তারিখ: ২২ সেপ্টেম্বর ১৯৭২।

 

সূত্র:

‘সমগ্র জাতির মধ্যে আমি প্রকাশিত’; আবু তাহেরের ৭৩তম জন্মদিন ও সিপাহী জনতার অভ্যুত্থানের ৩৬তম বার্ষিকী উপলক্ষে কর্নেল তাহের সংসদের স্মারক প্রকাশনা। (১৪ নভেম্বর, ২০১১)।

bottom of page