top of page

সেনাবাহিনীর স্বরূপ

ঔপনিবেশিক সেনাবাহিনীর স্বরূপ

 

শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর বাংলাদেশ ত্যাগের পর সবাই আশা করেছিল জাতীয় পুনর্গঠনের কাজকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হবে। শুরু হবে একটা সুষ্ঠু ও ন্যায়নিষ্ঠ সমাজ-ব্যবস্থা গড়ার কাজ। কর্নেল তাহেরের আশা ছিল একটা সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর বাংলাদেশের, যে দেশে দুর্নীতি ও মানুষে-মানুষে শোষণের কোনো সুযোগ থাকবে না। যে দেশে সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেশরক্ষা বাহিনীর সদস্যদের সম্পর্ক হবে আন্তরিক। সেনাবাহিনী হবে উৎপাদন প্রক্রিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই আশা, এই স্বপ্ন নিয়েই জাতি বারবার সংগ্রামে নেমেছে। এই আশায় বারবার উচ্চারিত হয়েছে আমাদের আদর্শ ও মূল্যবোধ। কিন্তু তা হয়ে ওঠেনি। কেউ বুঝে ওঠার আগেই অধঃপতনের ধারা শুরু হয়ে যায়।
বাহাত্তরের এপ্রিলে পায়ে অস্ত্রোপচারের পর অন্যান্য আনুষঙ্গিক চিকিৎসা শেষে দেশে ফেরেন তাহের। নিযুক্ত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন তিনি। শুরু করেন পরিশুদ্ধির কাজ। অবৈধ কাজ-কর্মের দায়ে কিছু উচ্চপদস্থ অফিসারের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
কয়েক মাসের মধ্যেই তাহেরকে কুমিল্লায় ৪৪তম ব্রিগেডের নতুন অধিনায়ক করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক ও পাকিস্তানি আদলে আরেকটি গণবিচ্ছিন্ন সেনাবাহিনীর পরিবর্তে ছোট আকারের উৎপাদনমুখী গণবাহিনী গড়ে তোলার পক্ষে ছিলেন তাহের। কুমিল্লায় তিনি তাঁর এই চিন্তাধারার পরীক্ষামূলক অনুশীলন শুরু করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ঢাকা ও কুমিল্লা সেনানিবাসে অর্জিত অভিজ্ঞতা তাহেরকে উৎপাদনবিমুখ স্থায়ী সেনাবাহিনীকে একটা বিপ্লবী গণবাহিনীতে পরিণত করতে উদ্বুদ্ধ করে। তাহের সৈনিক জীবনে লক্ষ্য করেন, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে একটা স্থায়ী সেনাবাহিনী জাতীয় অর্থনীতির ওপর একটি বোঝা স্বরূপ। এ ধরনের সেনাবাহিনী সমাজ প্রগতির পক্ষে একটা বিরাট বাধা। জাতীয় উৎপাদনে এদের কোনো অবদানই থাকে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে যে নিষ্ঠা, আনুগত্য ও ত্যাগের মনোভাব লক্ষ করেছিলেন তিনি, তাতে স্বাধীনতা উত্তরকালে একটা উৎপাদনমুখী বিপ্লবী গণবাহিনী গঠন করা অসম্ভব বলে তাঁর মনে হয়নি।
তাহের তাঁর চিন্তার ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর কাছে জাতীয় প্রতিরক্ষার একটি বিকল্প রণনৈতিক পরিকল্পনা পেশ করেন। যেখানে তিনি বলেছিলেন, জনগণ ও সেনাসদস্যরা মুক্তিযুদ্ধে একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধ শেষে তারা কেন বিচ্ছিন্ন হবে। কোনো অবস্থাতেই জনবিচ্ছিন্ন একটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলা সংগত হবে না, যা পাকিস্তানের মতো বারবার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করবে। এ কারণে সামরিক বাহিনীর গঠন কাঠামোর আমূল পরিবর্তন করতে হবে। এ ছাড়া সিপাহী ও অফিসারদের মধ্যে দাসসুলভ ও বৈষম্যমূলক সম্পর্কেরও অবসান ঘটাতে হবে। তাহের তাঁর পরিকল্পনায় উল্লেখ করেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যারাকে না থেকে দেশের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকা-ে অংশ নেবে। এভাবেই প্রতিরক্ষা বাহিনী জনগণের স্বার্থরক্ষাকারী গণবাহিনীেেত রূপান্তরিত হতে পারে। তবে দুর্ভাগ্য, বঙ্গবন্ধু তাহেরের এই পরিকল্পনা গ্রহণ করেননি। প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হলেও কুমিল্লায় তাহের সীমিত পরিসরে তাঁর চিন্তাধারার পরীক্ষা চালান। তিনি সৈনিক ও অফিসারদের একইসঙ্গে উৎপাদনমুখী কাজে লাগান। ঔপনিবেশিক ধাঁচের সেনাবাহিনীতে অফিসার ও জওয়ানদের মধ্যকার দূরত্ব ভেঙে দিতে চাইলেন তিনি।
কুমিল্লা ব্রিগেডকে একটা ‘গণবাহিনী’র মতো করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন তাহের। মুক্তিসংগ্রামে অংশগ্রহণকারী সেনাদের নিয়ে একটা শক্তিশালী সেনাবাহিনী গঠন করতে সব সময় চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তাঁর সামরিক সংগঠন প্রক্রিয়ার মূলনীতি ছিল ‘উৎপাদনমুখী সেনাবাহিনী’। এই আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে তাহেরের অধীনস্থ অফিসার ও সৈনিকরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শ্রমিক-কৃষকের সঙ্গে উৎপাদনে অংশ নেন। তাঁরা নিজেরা জমিতে হাল ধরেন, নিজেদের খাবার উৎপাদন করেন। উৎপাদন প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে গ্রামের মানুষের বাড়ি যান তাঁরা। এটাই ছিল স্বনির্ভর হওয়ার একমাত্র পথ। কুমিল্লা ব্রিগেড কিছু দিনের মধ্যেই একটা উৎপাদনমুখী শক্তিতে পরিণত হয়।
কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই বিরোধ দেখা দেয়। মুজিব সরকার সেনাবাহিনী গঠনের ব্যাপারটা উপেক্ষা করে আধা-সামরিক শক্তি রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলায় মন দেয়। ভারতীয় উপদেষ্টা ও অফিসারেরা এই রক্ষীবাহিনী গঠনে সরাসরি জড়িত ছিল। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে এ ব্যাপারে তাহের তাঁর পূর্ণ বিরোধিতার কথা জানান। যুদ্ধের সময় ভারতের সঙ্গে স্বাক্ষরিত গোপন চুক্তির ব্যাপারেও তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রতিবাদ জানান।
এই দুই কারণে আর প্রচলিত উপনিবেশিক কাঠামোর সেনাবাহিনী থেকে সম্পূর্ণভাবে সরে আসার ব্যাপারে তাহেরের ঐকান্তিক ইচ্ছার কারণে সরকারের সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনী থেকে সরে আসাটাই প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়ায়। বাহাত্তরের সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন কর্নেল তাহের। এরপর নিজের পথে এগিয়ে যান তিনি। পছন্দমত রাজনীতি বেছে নেন। যোগ দেন জাসদে।

bottom of page